রি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ক্রেতাদের শুল্কছাড়ের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে জায়গা করে নিয়েছে। '৭০-এর দশকে রাজধানীর বিভিন্ন ভবন ভাড়া করে উদ্যোক্তারা গার্মেন্টস চালু করেছেন। কালের বিবর্তনে এ খাতের উন্নতি হলেও অনেক উদ্যোক্তার কারখানাটি এখনো এই ব্যস্ত শহরেই রয়ে গেছে। বিভিন্ন মহল থেকে নানা সময় তাগাদা দেয়া হলেও এ বিষয়ে সাড়া দেননি উদ্যোক্তারা। রাজধানী জুড়ে পোশাক কারখানা থাকায় নানা ধরনের সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজধানীর এমন কোন এলাকা নেই যেখানে পোশাক কারখানা নেই। রামপুরা, বাসাবো, বনানী, উত্তরা, তেজগাঁও, মীরপুর, শ্যামলী, যাত্রাবাড়ী, গুলশান, বাড্ডা, ইস্কাটন, মৌচাক, মালিবাগ, শংকর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় এসব পোশাক কারখানা অবস্থিত। কোন কোন উদ্যোক্তা ব্যবসা বৃদ্ধি পাবার কারণে বাইরে কারখানা স্থাপন করলেও রাজধানীর কারখানাটি সরাননি। আবার অনেক উদ্যোক্তা অর্ডারের চাপ সামলাতে রাজধানীর কারখানাগুলোতে সাব-কণ্ট্রাক্টের কাজ করান। রাজধানীতে কারখানা থাকার কারণে এত শ্রমিকের থাকার যেমন সমস্যা হচ্ছে সাথে সাথে পণ্য পরিবহনের গাড়িও শহর দিয়ে অবাধ যাতায়াত করছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বহুবিধ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়া কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও জাপানে রপ্তানির ক্ষেত্রেও এ সুবিধা অব্যাহত আছে। ভারত, চীন ও কোরিয়ায় পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা আংশিক শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর বাইরেও নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি করলে (যেসব দেশে আগে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়নি) উদ্যোক্তারা দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা পান। এর বাইরেও স্থানীয় কাপড় সূতা ব্যবহার করলে সরকার পাঁচ শতাংশ বিকল্প নগদ সহায়তা দেয়।
এক সময় দেশীয় সূতা ব্যবহার করে পোশাক রপ্তানি করলে উদ্যোক্তারা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নগদ আর্থিক সহায়তা পেতেন। পোশাক শিল্পের সক্ষমতা বাড়ার পর এ সুবিধা আস্তে আস্তে কমে আসে। তবে নগদ আর্থিক সহায়তার বাইরেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারা নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন। এত সুবিধা ভোগ করার পরও রাজধানী থেকে কারখানা সরিয়ে নিতে অনেক উদ্যোক্তার অনীহা রয়েছে।
তবে সব উদ্যোক্তা যে একরকম তা নয়। বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে তাদের কারখানা রাজধানী থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে স্যুয়েটার খাতের উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে এগিয়ে আছেন।
তৈরি পোশাক শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, আমরা কেউ রাজধানীতে থাকতে চাই না। সরকারি সহায়তা পেলে উদ্যোক্তারা কারখানা সরিয়ে নেবে। মুন্সীগঞ্জের বাউনিয়াতে সরকার গার্মেন্টস পল্লী করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেখানে জমির দাম বেশি ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার থেকে জমি কেনার জন্য আমাদের কম সুদে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিলে আমরা এ সুবিধা ভোগ করতে পারবো। কারণ অনেক ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তার পক্ষে সরকার নির্ধারিত দাম দিয়ে জমি কেনা সম্ভব নয়। তিনি জানান, গার্মেন্টস পল্লী বাস্তবায়ন হলে চারশ' উদ্যোক্তাকে রাজধানী থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত কারখানাগুলোর অধিকাংশই পুরনো। সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারোশ' শ্রমিকের প্রাণহানির পর সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা শহরের ৩৫শ' কারখানা ভবন পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে বেশকিছু কারখানা ভবন ত্রুটিপূর্ণ।
বড় আকারে যেসব উদ্যোক্তা তৈরি পোশাক রপ্তানি করেন তাদের অনেকেই নানা খাতে তাদের ব্যবসা বাড়িয়েছেন। শুধু পোশাক কারখানা দিয়ে শুরু করলেও পরে তাদের বিনিয়োগ গেছে টেলিকম, হাউজিং, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, ব্যাংক, বীমা, নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রসারে '৭০-এর দশক থেকে যে দু'টি বিষয় কাজ করেছে তা হলো উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর কোটা সহায়তা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা। ১৯৮০ সাল থেকে তৈরি পোশাক বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানির তালিকায় নাম লেখাতে থাকে। ২০০২ সালে এসে বাংলাদেশ মোট ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, মূলত এই দশকজুড়ে বাংলাদেশের পোশাকের বাজার ক্রমাগত বেড়েছে। ২০০৫ সালে কোটা উঠে যাবার পরও বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা তাদের সক্ষমতা দিয়ে ক্রেতাদের ধরে রাখতে সক্ষম হন। ফলে যে বাংলাদেশ ২০০৭ সালে ১০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করতো তা আজ ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।