যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ পশ্চিমা কূটনৈতিক মহলে সব দলের অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনের কথা ওঠায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় বেশ চাপে আছে। পরিস্থিতি উত্তরণে দেশে-বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের কাছে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গত মাসে বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও হাইকমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে কেন ও কোন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন করতে হয়েছে, সে বিষয়ে বিদেশের মিশনগুলোতে অবস্থানপত্র পাঠানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে এর ভিত্তিতে বিশেষভাবে সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনসহ তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমমান ও গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে সরকারের অবস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়গুলোতে সরকারের সর্বশেষ অবস্থান তুলে ধরেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কিছু রাষ্ট্রের আপত্তির কথা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও স্বীকার করেছেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে হয়তো কারও কারও কিছু রিজার্ভেশন (আপত্তি) আছে। তবে সময় গেলে তারা বুঝতে পারবে, কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচন করতে হয়েছে। তা ছাড়া উপজেলা নির্বাচন ও উপনির্বাচন শেষে তাদের আরও উপলব্ধি হবে। তবে তিনি এটাও বলেন, সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। কারও সঙ্গেই অস্বাভাবিক সম্পর্ক নেই।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কূটনৈতিক চাপের বিষয়টি স্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা বিষয়টা হালকাভাবে নিচ্ছি না। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করব।’
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা এক সংবাদ সম্মেলনে যত দ্রুত সম্ভব একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির শুনানিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়। ওই শুনানিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ মন্তব্য করে বলেন, এ নির্বাচনে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। অর্ধেক আসনে নির্বাচনই হয়নি।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) এক জরিপে বলা হয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশ ভুল পথে এগোচ্ছে বলে ৫৯ শতাংশ নাগরিক মনে করেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও সাংবাদিকদের কাছে রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ কিছু বিষয়ে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকার কথা স্বীকার করেছেন
যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত আছে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে দেশটি বাংলাদেশের ওপর বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইইউ এবং জার্মানির রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা পররাষ্ট্রসচিব, বাণিজ্যসচিব ও শ্রমসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই সরকারের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। দেড় বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো থাকার কথা দাবি করলেও ড্যান মজীনার সঙ্গে টানাপোড়েনের কথা অস্বীকার করেন না। রাজনৈতিক বিষয়সহ কিছু বিষয়ে সরকার তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট।
সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্র থেকে নবনির্বাচিত সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ে সরকারের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।