উপজেলা নির্বাচন শেষ না করেই এক মাসের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) বিদেশ সফরে যাওয়ার কঠোর সমালোচনা করেছে বিরোধী ১৯ দলীয় জোট। পাশাপাশি এটাকে সরকারের ‘নীলনকশা’র অংশ বলে মনে করছেন নেতারা। সিইসির এ আচরণকে 'যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেনাপতির পলায়ন' বলেও মন্তব্য করছেন অনেকে।
তারা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুপস্থিতিতে নৈরাজ্য চরম আকার ধারণ করবে। এটা জেনে বুঝেও সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে রকিবউদ্দিন সাহেব নিউইয়র্কে গেছেন বলে তাদের মন্তব্য।
বিরোধী জোট মনে করছে, নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের না থাকাটা সন্দেহজনক। এতে করে গত দুই দফা নির্বাচনে যেসব অনিয়ম, কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স ছিনতাই ও জালভোট, প্রিজাইডিং অফিসারদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে পরবর্তী দফাগুলোতে তা চরম আকার ধারণ করবে। এর দায় দায়িত্ব প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেই নিতে হবে। সরকারের যে নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আর রকিবউদ্দিন আহমদ দেশ ও জনগণের দুর্দিনে সবসময় পালিয়ে যান- তার দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন জোটের এক নেতা।
সোমবার আলাপকালে ১৯ দলের নেতারা বলেছেন, প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা অধিক জয় পেয়েছে, অনিয়ম কারচুপি কিছুটা কম হয়েছে। হেরে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তাই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আওয়ামী পরিবারের লোকজন প্রশাসনকে ব্যবহার করে ব্যাপক কারচুপি করে। তারা কেন্দ্র দখল করে জালভোটের মহোৎসব করেও বিএনপির চেয়ে বেশি আসনে জয়ী হতে পারেনি। এ অবস্থায় সরকার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। নানা রকম হুমকি ধামকি দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন- আরো কঠোর হবেন। এ অবস্থায় পরবর্তীতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনচলাকালীন নির্বাচন কমিশন প্রধানের না থাকাটা প্রশ্নের জন্ম দিবে।
এক মাসের জন্য নির্বাচন কমিশনারের বিদেশ গমনের বিষয়ে জানতে চাইলে এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বাংলামেইলকে বলেন, 'অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। তিনি অন্ধের ভুমিকা পালন করছেন। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। একদিন না একদিন তাকে বিচারের সম্মুখিন হতে হবে।'
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'তাকে আমি ১৯৭২ সাল থেকে চিনি। তিনি নিজের চাকরির কথা চিন্তা করেন। দেশ ও জনগণের বিপদের সময় পালিয়ে যান, পালিয়ে থাকেন।'
তিনি বলেন, 'বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়, তাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। এটা সঠিক নয়। ক্ষমতা প্রয়োগ করার মতো মনমানসিকতা তাদের নেই। তারা সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছে। জনগণ ও দেশের স্বার্থ রক্ষা করছেন না।'
সিইসির বিদেশ ভ্রমণ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলামেইলকে বলেন, ‘এ নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। তারা সরকারের নির্দেশে কাজ করে। তার (সিইসি) বাইরে চলে যাওয়া মানে এ নির্বাচনকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না।'
দু'দফা নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, তাতে সরকারপক্ষের লোকেরা কেন্দ্র দখল ও ভোট কারচুপি এবং নির্বাচনে জবরদস্তি করেছে। এখন নির্বাচন কমিশনার না থাকাই এ বিষয়েগুলো আরো চরম পর্যায়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'দু'দফা নির্বাচনে সরকারের সমর্থকরা পরাজিত হওয়ায় বাকি উপজেলাগুলোতে জয়ী হতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমরা খবর পাচ্ছি, প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদেরকে পরিবর্তন করে সরকারের নিজস্ব লোকজনকে বসানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে করে আগামী নির্বাচনগুলো কখনই সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচনকালীন প্রধান কমিশনারের বিদেশ অবস্থান করাটা নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক এবং জনগণের মনে প্রশ্নের জন্ম দেবে।'
বিস্ময় প্রকাশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, 'সারাদেশে এতো গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা রেখে তিনি বিদেশে চলে গেলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য! আমি মনে করি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেনাপতি পলায়ন করেছে।'
বিদেশ যাওয়াকে রহস্যজনক মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'নির্বাচন কমিশনার যদি সরকারের চাপে বিদেশ যেতে বাধ্য হয়ে থাকেন, তাহলে জনগণ তা জানতে চাইবে। নির্বাচনের সময় প্রধান কমিশনার উপস্থিত না থাকায় অনিয়ম আরো বেশি হবে।' যেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকতেই দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, সেখানে তার অনুপস্থিতিতে সরকার কী করে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করে আসছে বিএনপি ও তাদের শরিকরা। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন কখনোই সুষ্ঠু হবে না দাবি করে দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনের দিনও নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলামেইলকে বলেন, 'নতুন করে আর কিছু বলার নেই। এ কমিশন দশম জাতীয় নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে। সংসদকে কলঙ্কিত করেছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সরকারের পক্ষে কাজ করেছে। উপজেলা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে তারা কাজ করছেন। এখন সরকার যাতে আরো ভালো করে নির্বাচনে কারচুপি করার সুযোগ পায় সেজন্য তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।'
এ বিষয়ে জাগপার চেয়ারম্যান শফিউল আলম প্রধান বাংলামেইলকে বলেন, 'একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সরকারের যে নীল নকশা রয়েছে তা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তিনি বিদেশে চলে গেছেন।'
উল্লেখ্য, এক মাসের ব্যক্তিগত সফরে নিউইয়র্কের উদ্দেশে সোমবর সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ঢাকা ত্যাগ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এক মাসের সফরে তিনি সেখানে তার মেয়ের বাসায় থাকবেন। তবে এর মধ্যে কোনো একদিন বিশ্বব্যাংকের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ফলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুপস্থিতিতেই ১৫, ২৩ ও ৩১ মার্চ সারাদেশে ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ধাপের উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।