রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানার ছাদ থেকে পড়ে শাহ আলম সাগর নামের এক সাংবাদিকের মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বলছে, থানার ছাদ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে সাগরের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সরজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ওই ছাদ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। আর কেনই বা সাগর পালাতে যাচ্ছিল সে প্রশ্নেরও কোন উত্তর মিলছে না। সাগর যাকে সহযোগিতা করতে থানায় গিয়েছিলেন পুলিশ উল্টো সেই নজরুল ইসলাম মিস্ত্রিকেই মামলার প্রধান আসামি করেছেন। আসামি করা হয়েছে নজরুলের সঙ্গে বিরোধ হওয়া ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমেদ ভূঁইয়াকে। যেখানে মামলার বাদী হওয়ার কথা নিহতের স্ত্রীর, সেখানে তড়িঘড়ি করে পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেছে। পুলিশের দাবি, সাগরের ছাদ থেকে পালানোর সময় বশির আহমেদ ভূঁইয়া থানায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু বশির আহমেদ জানিয়েছেন, প্রথমবার থানায় গিয়ে কলেজে ফিরে আসার পর পুলিশ তাকে রাতে আবার থানায় ডেকে নিয়ে যায়। দুই-তিন ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখার পর তাকে রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। সকালে আবার থানার ওসি রফিকুল ইসলাম তাকে আশ্বাস দেন, আপনার কিছুই হবে না। আপনি সহজেই জামিন পেয়ে যাবেন। মামলা সেভাবেই সাজানো হয়েছে। অপরদিকে নিহত সাগরের স্ত্রী সোমা আক্তার অভিযোগ করে বলছেন, আমার স্বামী পাগল না যে ৭ তলার ছাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তাকে থানায় পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে। পরে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে নাটক সাজিয়েছে।
গত রোববার সন্ধ্যায় উত্তরা পশ্চিম থানার ছাদ থেকে পড়ে মারা যায় স্বল্প প্রচারিত দৈনিক অপরাধ দমন ও পথযাত্রা পত্রিকার সাংবদিক শাহ আলম মোল্লা ওরফে সাগর। গতকাল সরজমিন থানায় গিয়ে দেখা গেছে, উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের ৪৮ নম্বর ৬ তলা কর্নার ভবনটি থানা ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৬ তলার ছাদে অর্ধেক পুলিশ ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওই ভবনের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে রাস্তা এবং উত্তর ও পূর্ব কোণে ফাঁকা প্লট। ওই ভবনের ছাদ থেকে পালিয়ে নামার কোন সুযোগই নেই। স্থানীয় সূত্র জানায়, থানায় সাগরকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। একই সঙ্গে আগামীতে আর কোন প্রতিবেদন প্রকাশ না করার জন্য বলা হয়। ওই সূত্র জানায়, থানা কমপেক্সের ছাদে ওঠার প্রবেশ পথ সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। সেখানে পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে সাগরের থানার ছাদে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাকে হয় নির্যাতন করে হত্যার পর ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে তা না হলে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়েছে।
পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, উত্তরার ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমেদের বিরুদ্ধে নজরুল ইসলাম নামের এক কাঠমিস্ত্রির গচ্ছিত অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার আত্মসাৎ করার খবর প্রকাশ করেছিলেন সাগর। গত ২২শে ফেব্রুয়ারি এ খবরটি প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে বশির আহমেদের সঙ্গে নজরুল মিস্ত্রির বিরোধ সৃষ্টি হয়। গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলাম মিস্ত্রি উত্তরা পশ্চিম থানায় গিয়ে বশির আহমেদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১৪৪৬) করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার জিডির তদন্ত কর্মকর্তা থানার এসআই সোলেমান দু’পক্ষকেই থানায় ডাকেন। এ সময় থানার ওসি রফিকুল ইসলাম তাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। এর মধ্যে হাজির হয় নজরুল মিস্ত্রির প্রথম স্ত্রী মর্জিনা। তিনি দাবি করেন, গচ্ছিত ওই অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার তার। তার স্বামী বাসা থেকে এসব চুরি করে এনেছে। ওসি তাকে বিষয়টি তুরাগ থানায় গিয়ে মামলা করার পরামর্শ দেন। ওসি রফিকুল ইসলাম তাদের সবাইকে বিদায় দেয়ার পর মর্জিনা তাদের নিয়ে টানাটানি করে। এ সময় সবার অগোচরে সাগর থানার ছাদে উঠলে বশির আহমেদ ডেকে আনতে পাঠায় নজরুল ইসলামকে। নজরুল ছাদে গিয়ে সাগরকে নিচে নামিয়ে আনতে চাইলে সে উত্তর-পূর্ব দিকের কর্ণারের সানশেড দিয়ে নামার চেষ্টা করলে নিচে পড়ে যায়। পরে নজরুল ইসলাম নিচে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে কথিত আরও তিন সাংবাদিক সুজন, সুলতান ও রিয়াজ তাকে ধরে।
এদিকে বশির আহমেদের বরাত দিয়ে তার বড় ভাই সালেহ আহমেদ ভুঁইয়া দাবি করেন, কয়েক দিন আগে সাগরসহ কয়েক সাংবাদিককে নিয়ে নজরুল মিস্ত্রি তার অফিসে যায়। এ সময় তিনি গচ্ছিত অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার ফিরিয়ে দেন। তারপরও সাংবাদিকরা তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিল। রোববার জিডির তদন্ত কর্মকর্তা তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। বিকাল পাঁচটার দিকে তিনি থানায় যান। এক পর্যায়ে ওসি রফিকুলের পরামর্শে ওই সাংবাদিক সাগরের বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন। জিডি করার পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে আবার অফিসে ফিরে যান। সন্ধ্যা ৭টার পরে ওসি তাকে আবার থানায় ডেকে নিয়ে সাগর নিহত হওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। তিনি বলেন, গতকাল সকাল ১১টার দিকে কয়েকজন সঙ্গীসহ থানায় গিয়ে বশির আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে চান। এ সময় ওসি রফিকুল ইসলাম তাকে বলেন, ‘প্রিন্সিপাল কি চোর নাকি? তাকে হাজত খানায় দেখতে যাবেন?’ এ কথা বলে তিনি প্রিন্সিপাল বশিরকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে চেয়ারে বসান। এসময় ভাবলেশহীন প্রিন্সিপালকে ওসি বলেন, ‘আপনি এত উদ্বিগ্ন কেন? ঘটনা ঘটছে আমার থানায়। কিছু হলে আমার হবে। আমি এটা বুঝবো। আপনি আজকেই জামিন পেয়ে যাবেন।’
সালেহ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ওসির আশ্বাস পেয়ে তারা ফিরে আসেন। কিন্তু দুপুরে আদালতে গিয়ে দেখেন তাকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে। রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে ১০ দিনের। থানা থেকে মামলার কপি তাদের দেখতে দেয়া হয়নি। তারা আদালত থেকে মামলার নকল কপি তুলে দেখতে পান তার ভাইকে জড়িয়ে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, বশিরের ভয়ে সাগর থানার ছাদ দিয়ে পালাচ্ছিল। তিনি প্রশ্ন করেন, থানায় ডাকা হয়েছিল ঘটনা সমাধানের জন্য। কিন্তু সেখানে ভয় পেয়ে কেউ ছাদে উঠে পালাবে এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। তিনি বলেন, ওসিসহ থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের গা বাঁচাতে অন্যদের জড়িয়ে মামলা দিয়েছে।
উত্তরায় মহাসড়ক অবরোধ: এদিকে গতকাল উত্তরা এলাকার বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদকর্মীরা প্রায় ১ ঘণ্টা উত্তরার আজমপুর আমীর কমপ্লেক্সের সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এর আগে সংবাদকর্মীরা একটি মানববন্ধনও করেন। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।