ব্রিটেনে এখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এ যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বহু আলোচনা হচ্ছে, বহু প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হচ্ছে। সাধারণভাবেই মিডিয়ায় বহুবিধ আলোচনা চলছে। এসব থেকে জানতে পেরেছি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা বেলজিয়াম, হল্যান্ড, নরওয়ে ও ডেনমার্ক আক্রমণের পর ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছিল যে তারা এসব দেশে এসেছে ‘আগ্রাসী ব্রিটিশদের’ আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করতে। অবশ্য এসব দেশে এবং অন্যান্য দেশেও কেউ জার্মান প্রচারণায় বিশ্বাস করেনি, সেসব প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়নি।
আরও পরে নাৎসীবাদের উদ্ভবের সময় থেকে ক্ষমতা লাভের জন্য মিথ্যা প্রচারণা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ তাদের বড় রাজনৈতিক কৌশল ছিল। আপনাদের অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন হিটলারের নাৎসীরা রাতের আঁধারে বুন্ডেস্ট্যাগ (পার্লামেন্ট) ভবন পুড়িয়ে দেয় এবং সে অপকর্ম কমিউনিস্টরা করেছে বলে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি তখন নতুন নাৎসী পার্টির চাইতেও শক্তিশালী ছিল। সুতরাং জনসাধারণকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। জার্মানরা আরও প্রচারণা চালায় ট্রেড ইউনিয়নপন্থীদের, ইহুদিদের, উন্মাদ আর সমকামীদেরও বিরুদ্ধে। তাদের সবাইকে বিভিন্ন বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়। এসব শিবিরে ৬০ লাখ ইহুদি এবং লাখো লাখো অন্যরা মারা গিয়েছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নািসদের অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা এবং হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবেলসের কথা নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। গোয়েবেলস বলতেন, বার বার করে বলা হলে ঘোর মিথ্যাকেও মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করে। বাংলা প্রবাদে বলে, চোরের সাতদিন আর গৃহস্থের একদিন। নািসদের মিথ্যার বেসাতি এবং তাদের নজিরবিহীন সমরশক্তি অবশেষে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়েছিল। অধিকৃত কোনো দেশ গোয়েবেলসের মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করেনি। সব দেশেই গোপন প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে। শেষে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে তারা জার্মানিকে বিধ্বস্ত ও পরাজিত করেছিল। দর্পচূর্ণ হিটলার সস্ত্রীক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান জাতি নতুন পথ ধরেছে। সংঘাতের পরিবর্তে তারা সমঝোতা ও সংলাপের পথে চলেছে। তার সুফল এখন সবাই দেখছেন। হিটলার গোটা ইউরোপের প্রভু হতে চেয়েছিলেন যুদ্ধ করে। বর্তমানের জার্মানি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান দেশ, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলো মের্কেল ইউরোপের সবচাইতে প্রভাবশালী রাজনীতিক। ইউরোপের দেশগুলোর নেতারা রীতিমত তার অনুগ্রহ চান। মাত্র গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার তিনি একদিনের সফরে লন্ডন এসেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধান না হলেও ব্রিটিশরা তাকে রাষ্ট্রপ্রধানের সমান লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে। মিসেস মের্কেল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উভয় পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং বিকালে চা খেয়েছেন বাকিংহাম প্রাসাদে রাণীর সঙ্গে। মনে পড়ে, ১৯৯২ সালে বার্লিনের এক সেমিনারে অ্যাঞ্জেলো মের্কেল বসেছিলেন আমার পাশে। তখন তিনি স্থানীয় রাজনীতিক এবং সমাজকর্মী। নিজের অধ্যবসায়, ঐকান্তিকতা এবং সততার দ্বারা তিনি জার্মান জাতির বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
সে মুখোশ খুলে যাবেই
বলছিলাম যে মিথ্যা অপপ্রচারে সাময়িক সুবিধা হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মিথ্যার মুখোশ খুলে যাবেই। অসাধু উপায়ে যে যত ওপরে উঠবে তার পতন হবে ততই সাংঘাতিক। প্রকৃত সম্মানের সঙ্গে ক্ষমতা পাওয়ার শ্রেয়তর উপায় হচ্ছে শান্তিপূর্ণ রাজনীতি, আলোচনা ও সংলাপ। অ্যাঞ্জেলো মের্কেল বিশ্ববাসীকে সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশে এখন চলছে নািসদের অনুকরণে মিথ্যা অপপ্রচারের জোয়ার। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রায় সব মন্ত্রী অর্বাচীনের মতো প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং এ দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অবিরাম মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যবশত তাদের অনেকে এমন ভাষা ব্যবহার করছেন যা ভদ্র সমাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। খুব সম্ভবত যেসব পরিবারে তাদের জন্ম হয়েছিল সেসব পরিবারে ভব্যতা কিংবা সংস্কৃতির নামগন্ধও ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামও গোয়েবেলসর অনুকরণে বলেছেন, একই মিথ্যা বার বার বললে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যায়। মি. ইমাম উচ্চশিক্ষিত। গোয়েবেলসের মিথ্যা প্রচারণার পরিণতি কী হয়েছে তিনি নিশ্চয়ই জানেন। বর্তমান অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী হাছান মাহমুদ সকাল-সন্ধ্যা নিত্যনতুন মিথ্যা অভিযোগ করে যাচ্ছেন প্রতিপক্ষের, বিশেষ করে বিএনপি নেত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। এসব থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নািস পন্থায় ক্ষমতা দখল করার ও আঁকড়ে থাকার কৌশল বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে
ভোটবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় ও কাজে নাৎসীদের বুন্ডেস্ট্যাগ পুড়িয়ে দেয়ার কথা মনে পড়ে। বর্তমানে দেশে অপকর্মগুলো করছে আওয়ামী লীগ, কিন্তু কর্কশ কণ্ঠে সেসব সহিংস দুষ্কৃতির দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। তার শাসনকালে কয়েক হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাবের এবং আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের হাতে বিগত দু’বছরে ছয়শ’রও বেশি রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছেন। গুম-খুন হয়েছেন দুইশ’রও বেশি। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী আজও নিখোঁজ। তাকে এবং তার ড্রাইভারকে র্যাব ঢাকার বনানীতে গাড়ি থেকে টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে এখন সরকার ও দুষ্কৃতকারী এবং সন্ত্রাসীরা সমার্থক হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদের এই হচ্ছে বৈশিষ্ট্য।
হিটলারের নাৎসীরা ভিন্ন মতের পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে, বহু লেখক-সাংবাদিককে বন্দি শিবিরে বছরের পর বছর আটক রেখেছে, ভিন্ন মতের লেখকদের হাজার হাজার বই স্তূপাকার করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে বিনা বিচারে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেলে পুরে রাখা, ইসলামিক ও দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া, আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় তালা লাগানো এবং ২৪ জন সাংবাদিকের হত্যা নাৎসীদের কাছ থেকে ধার করা টেকনিক।
আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভয় দেখিয়ে ভোট পাওয়ার আশায় এবং ভোট না পেলে প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের মন্দির ও দেবমূর্তি ভেঙে ফেলছে। যুবলীগ-ছাত্রলীগের সদস্যদের ‘চাঁদা’ না দেয়ার কারণেও বহু হিন্দু নির্যাতিত হয়েছেন। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনের দিন পটিয়া উপজেলায় দুটি হিন্দু বাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। সে দুটি বাড়ির লোকেরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাসির আহমেদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তার লোকেরাই তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে।
নািস স্টাইলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার চেষ্টাও করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। পুলিশকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে পুলিশ-র্যাব। পরদিন কিংবা দু’একদিন পর তাদের অনেকের হাতবাঁধা লাশ পাওয়া যাচ্ছে এখানে-সেখানে। আসাদুজ্জামান নূরের মিছিলে হামলার জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, একের পর এক তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে এখানে-সেখানে। চলতি বছরের প্রথম ৪৬ দিনে এ রকম ৪৬টি লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ হেফাজতে বন্দি রাজনৈতিক কর্মীরা কোথায় বন্দুক পায়, কীভাবে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করে মারা যায়—কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষ বুঝতে পারে না। গুম-খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ৫ জানুয়ারির ক্যুর পর অনেক বেড়ে গেছে। গত বছরের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে যে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে, স্বয়ং হিটলারও বোধ করি তাতে আতঙ্কিত হতেন।
বিএনপি যখন সরকারে ছিল, শেখ হাসিনার নৈমিত্তিক একটা প্রচারণার কথা আপনাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা। হাসিনা জোর গলায় প্রচার করছিলেন যে খালেদা জিয়া ‘ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং‘ দিয়েই ভোটে জিতেছেন এবং সরকার গঠন করেছেন। বিশেষজ্ঞরা আওয়ামী লীগ নেত্রীর কাজকর্মেই বরং ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাধান্য দেখছেন। বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ক্যু বলা সঙ্গত এ কারণে যে দেশের মানুষের সম্মতি নিয়ে নয়, তাদের বিরোধিতা ও প্রতিবাদের মুখেই হাসিনা ও আওয়ামী লীগ গদি দখল করে নিয়েছে।
নির্বাচনে দুর্বৃত্তপনা
সংসদের অধিকাংশ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি, ৫০ শতাংশের বেশি চার কোটি ৯০ লাখ ভোটদাতাকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অবশিষ্ট যে ১৪৭ আসনের জন্য নির্বাচন হয়েছে তাতে বিভিন্ন মহলের মতে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ মাত্র ভোট পড়েছে। তার পরও সরকার গোটা কূটনৈতিক সম্পদ ব্যবহার করে বিদেশে প্রচার চালাচ্ছে এই বলে যে তারা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। এই অপপ্রচারে তাদের সাহায্য করছে তাদের ভারতীয় পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবকরা।
বিএনপির নেতৃত্বে ১৯ দলের জোট সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। সরকার তড়িঘড়ি উপজেলা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল এ আশায় যে বিরোধী জোট এ নির্বাচনও বয়কট করবে এবং তারা তাদের বিদেশি প্রভুদের দেখাতে পারবে যে তারা প্রকৃতই দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াতের নির্বাচন করার ঘোষণায় খুবই বেকায়দায় পড়েছে সরকার। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নানা রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছে, নিত্যনতুন কৌশল উদ্ভাবন করছে।
সেসব প্রস্তুতি ও কৌশল যে কী ছিল এখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই। এমন কোনো নির্বাচনী দুর্নীতি নেই যা আওয়ামী লীগ প্রথম ও দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনে করেনি। তাদের ক্যাডাররা ভোট কেন্দ্র দখল করে ভুয়া ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরাট করেছে, বিরোধীদের নির্বাচনী এজেন্টদের তারা ভয় দেখিয়ে এবং পেশিশক্তির জোরে ভোট কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত করেছে। প্রিসাইডিং অফিসারকে এবং পুলিশকেও কোথাও কোথাও ভুয়া ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরাট কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বহু স্থানে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলার ডেপুটি কমিশনার মুখেশ চন্দ্র বিশ্বাস স্বীকার করেছেন যে বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার হরিণমারীতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভোটারদের বাধা দিলে ১৯ দলের জোটের কর্মীরা প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে। পুলিশ তাদের বাধা দিলে যে সংঘর্ষ হয়, ৪ বিজিবি সদস্যসহ ৯ জন তাতে আহত হয়েছেন। কোম্পানিগঞ্জ ও ক্ষেতলালে দুজন প্রিসাইডং অফিসার আওয়ামী লীগ কর্মীদের অত্যাচারে হার্টফেল করে মারা যান।
প্রথম দুই উপজেলা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়
এতসব করেও আওয়ামী লীগ ভরাডুবি এড়াতে পারেনি। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে বিএনপি ৫২টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে আর আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে ৪৬টিতে। প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনেও হেরে গেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রায় দ্বিগুণ ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি যেখানে ৪৪টি উপজেলা জয় করেছে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ৩৪টি উপজেলায় জয়ী হয়। যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে উভয় নির্বাচনে, সেসব না হলে আওয়ামী লীগ এক ডজন উপজেলায়ও জয়ী হতো কিনা সন্দেহ আছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হবে যে গত বছর যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগ সবগুলোতেই পরাজিত হয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের দুর্গ নামে পরিচিত গাজীপুরেও ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছিল। বাকি উপজেলাগুলোতে জয়ী হওয়ার আশায় আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের আরও হিংস্র হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কথা হচ্ছে এতসব দুর্নীতি করেও আওয়ামী লীগ অবশিষ্ট তিনটি উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে কিনা। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, গুণ্ডামি ইত্যাদি দুর্নীতিগুলো কিছু কম হলেই বেধড়ক মার খাবে আওয়ামী লীগ বাকি উপজেলা নির্বাচনগুলোতেও। বিশ্বের কোথাও কেউ এখন আর বিশ্বাস করে না যে আওয়ামী লীগের পেছনে জনসমর্থন আছে। ভারতীয় কূটনীতিকদের ব্যাপক প্রচেষ্টা আর বৃহত্ শক্তির স্বার্থের মারপ্যাঁচে শেখ হাসিনার সরকার ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও এ যাবত্ কোনোমতে টিকে আছে। কিন্তু তাদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তীব্রতর করে তুলে বাকশালী কায়দায় স্থায়ীভাবে গদি দখল করে থাকাই শেখ হাসিনার পরিকল্পনা। সম্প্রতি তিনি বলতে শুরু করেছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ তিনি বাংলাদেশকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবেন।
বাংলাদেশের মানুষ এখন খাবি খাচ্ছে। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। জান-মালের নিরাপত্তা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই এই দেশে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘ক্রসফায়ারের’ রহস্য এখন সবার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু দলীয়কৃত পুলিশ, র্যাব আর আদালতের কল্যাণে ন্যায়বিচারের অধিকারও হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশের মানুষ। সরকারি দলের গুণ্ডারা মানুষের সহায়-সম্পত্তি, এমনকি নারীর সম্ভ্রমও ছিনিয়ে নিচ্ছে। দেশের সম্পদের একটা বিরাট অংশ লুট হয়ে গেছে। মালয়েশিয়া, দুবাই আর লন্ডনে সে সম্পদ দিয়ে সম্পত্তি কেনা হয়ে গেছে। একদিকে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, তার ওপর গ্যাস-বিদ্যুত্ ইত্যাদির ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি মধ্যবিত্তের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আরও এক দফায় বিদ্যুতের দাম প্রায় সাত শতাংশ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। দুর্নীতি কিংবা চুরি যারা করছেন না তারা এখন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য খাবি খাচ্ছেন। শেখ হাসিনার স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাদেশের মানুষকে বেহেশতে যেতে হবে।
দেশের সর্বনাশ, বিদেশিদের জন্য দাক্ষিণ্য
দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কারও কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের শিক্ষিত ছেলেরাও উপসাগরীয় দেশগুলোতে, মধ্যপ্রাচ্যে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো দেশে কুলি-মজুরের কাজের জন্য ছুটছে মরিয়া হয়ে এবং ধারকর্জ করে। পথে এবং বিদেশে তারা লুণ্ঠিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। মাত্র গত বছরে তাদের ১২,০০০ লাশ এসেছে বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশে ভারতীয়দের চাকরির অভাব হয় না। তৈরি পোশাকের এবং অন্যান্য শিল্পে এখন চাকরি করছে কম সে কম পাঁচ লাখ ভারতীয়। গত বছর তারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ৩৭১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এবং সন্দেহ করা হচ্ছে ভারতের লাভের জন্য বাংলাদেশের শিল্পগুলো ধ্বংস করার লক্ষ্যে তাদের অনেকে সাবোটাজ চালাচ্ছে নিজ নিজ কর্মস্থলে।
হাসিনা কেন ভারতকে তোয়াজ করছে কারোই বুঝতে বাকি নেই। দিল্লির অনুগ্রহে ২০০৮ সালে তিনি ক্ষমতা পেয়েছিলেন এবং আজও গদিতে আছেন দিল্লির অনুগ্রহে। জনসমর্থনবিহীন হাসিনা স্বৈরশাসন চালাচ্ছেন বাংলাদেশে। কিন্তু সে ধরনের অবস্থা তার ভারতীয় অভিভাবকরাও নিজেদের দেশে বরদাশত করবেন না। গোপন চুক্তি করে, জনসাধারণের অজান্তে তিনি ভারতকে বিনা ফিতে সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্রানজিট দিয়েছেন, বিনা মাশুলে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরও অবাধ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। বিনিময়ে কী পেল বাংলাদেশের মানুষ? তাদের চাকরি-বাকরি নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয়রা। বাংলাদেশের কল-কারখানা বিনাশ করে ভারতের উত্পাদনকে একচেটিয়া করে নিচ্ছে। তাদের যে পণ্য অন্যত্র বিক্রি হয় না সেগুলো বাংলাদেশে ডাম্প করা হচ্ছে। বাণিজ্যের ভারসাম্য বহু হাজার কোটি ডলার ভারতের অনুকূলে এবং সে ব্যবধান বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাপ্যটাও দিতে ভারত অস্বীকার করছে। ১৯৭৪ সালে হাসিনার পিতা সীমান্ত সহজীকরণ চুক্তি করেছিলেন ভারতের সঙ্গে। কালবিলম্ব না করে তিনি সংবিধান সংশোধন করেছেন, বেরুবাড়ী ছিটমহলটা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু সে চুক্তি ভারত আজও অবধি পালন করেনি, তিন বিঘা ছিটমহলটি বাংলাদেশ আজও পায়নি। আজ অবধি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি ভারত।
মনমোহনের দুঃখ
মনমোহন বলেছেন তিনি আসছে নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী থাকতে চান না। সে নির্বাচন হবে খুব সম্ভবত মে মাসে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা প্রায় একবাক্যে বলছেন, সে নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যাবে। সেক্ষেত্রে মনমোহনের প্রধানমন্ত্রী থাকার প্রশ্নও উঠত না। মনমোহন সিং মিয়ানমারে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাত্ করেছেন, উপরোক্ত চুক্তি দুটি বাস্তবায়ন না করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মনমোহনের দুঃখ প্রকাশে বাংলাদেশের মানুষের পেট ভরবে না, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের মন বিষিয়ে উঠবে মাত্র। ভারত আন্তর্জাতিক চুক্তি পালন করে না। অথচ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। সুন্দরবন ধ্বংস করার বিপদ অগ্রাহ্য করে ভারতকে বাংলাদেশের মাটিতে পরিবেশ বিনাশী কয়লা জ্বালানো বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন করতে দিয়েছেন।
অত্যাচারী শেখ হাসিনা এবং তার অত্যাচারী বর্বর সরকারকে অবিলম্বে টেনে নামানো না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিলীন হয়ে যাবে, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। বিএনপি তাদের কিছু ভ্রান্ত নীতি ও ভুল কৌশলের কারণে দীর্ঘ আন্দোলনেও এই সরকারকে গদিচ্যুত করতে পারেনি। খালেদা জিয়া রাজবাড়ীর বিশাল জনসভায় বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনগুলো শেষ হয়ে গেলে তিনি আবার তার ১৯ দল নিয়ে নতুন ও সংশোধিত কৌশলে আন্দোলন শুরু করবেন। সেটা আশার কথা। কিন্তু বিএনপি মহল থেকে শোনা যাচ্ছে সেটা শুরু হবে মে মাসে। এটা দেশের মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না। উপজেলা নির্বাচন শেষ হবে মার্চ মাসের মধ্যেই। তাহলে মে মাসের জন্য অপেক্ষা কেন? খালেদা জিয়ার জানা থাকার কথা, এক মাস বেশি সময় পেলে সরকার তাদের স্বৈরতন্ত্রী ভিত্তি পাকা করার বাড়তি এক মাস সময় পাবে। (লন্ডন, ০৪.০৩.১৪)
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নহেন।