দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম নক্ষত্র ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এখনো পর্যন্ত রাজনীতিতে তার কদর অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও তাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই তারপরও মওদুদ ছাড়া যেন বাংলাদেশের রাজনীতি অচল! ইদানিং কী হলো? বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ যিনি মাসের অধিকাংশ দিনই জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘হাজিরা’ দিতেন। কতিপয় ‘ভূইফোড়’ সংগঠনকে পৃষ্ঠপোশকতার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব সংগঠনগুলোতে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করতেন। কেন্দ্রের সিনিয়র নেতারা এ বিষয় নিয়ে রীতিমত মওদুদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেন।
দপ্তরের দায়িত্বে থাকা রিজভী আহমেদ বেশ কয়েকটি সংগঠনকে ‘ভূইফোড় সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। ‘ভূইফোড়’ নেতারাও রিজভীকে পাল্টা হুমকি দেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। মওদুদের সঙ্গে টক্কর মারতে গিয়ে স্থায়ী কমিটির একজন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন বলেও রয়েছে গুঞ্জন।
মওদুদের উপস্থিতি ছাড়া গণমাধ্যমও যেন তাদের খোরাক পেতো না! কিন্তু সেই মওদুদ এখন একেবারেই গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন! নাকি কোনো চাপে রয়েছেন তিনি। চাপ হলেও তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন যে, সেটা কোন পক্ষের চাপ?
গত বছরের ৫ অক্টোবর সিলেটে ১৮ দলীয় জোটের জনসভায় গিয়েছিলেন বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ। সেখান থেকে ফিরেই ভর্তি হন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাসহ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারা তাকে দেখতে গেলেও খালেদা জিয়া যাননি। এ নিয়ে দলের মধ্যে নানা ধরনের সন্দেহ আর বিতর্ক তৈরি হয়। এর কয়েকদিন পরই উচ্চ চিকিৎসার জন্য মওদুদ চলে যান সিঙ্গাপুর। এরপর থেকেই তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন মুখরোচক খবর পরিবেশন করা হয়। কারো কারো ধারণা ছিল মওদুদ আহমেদ দেশে ফিরে তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্ব দেবেন। কারো ধারণা ছিল তিনি মূলত আওয়ামী লীগকেই সহযোগিতা করবেন! আবার কেউ বলেছিলেন, মওদুদ আহমেদকে নিয়ে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশে ফিরে এ বিষয়ে তিনি জবাব দেবেন। কিন্তু দেশে ফিরে মওদুদ এ বিষয়ে একটি কথাও বলেননি।
জানা গেছে, মওদুদ আহমেদ তার ঘনিষ্টদের কাছে বলেছেন তাকে নিয়ে রাজনীতিতে যে বিতর্ক রয়েছে, মৃত্যু হলেও তা নিয়েও বির্তক হবে। বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আবারো ‘প্রেসক্লাব ভিত্তিক’ জাতীয়তাবাদীমনা সংগঠনগুলোকে আবারো সক্রিয় করেন মওদুদ আহমেদ। সকাল-বিকাল সপ্তাহের প্রত্যেক দিনই মওদুদের উপস্থিতি ছিল।
গত ৮ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান শেষে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন মওদুদ আহমেদ। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করেন তিনি। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই। বিশেষ করে তাকে ঘিরে জাতীয় প্রেসক্লাবে যে কয়েকটি সংগঠনের পদাচারণা ছিল তাদের ‘দোকানে’ এখন মাছিও উড়ে না। সম্প্রতি নোয়াখালীতে গণমাধ্যমের সঙ্গে মওদুদ আহমেদ কথা বলেছেন। এছাড়াও গত সোমবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সঙ্গে মওদুদ আহমেদ বৈঠক করেছেন বলেও জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, মওদুদ আহমেদ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামী ৬ মাস তিনি গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলবেন। দলীয় ফোরামের বাইরে তিনি কোনো প্রকার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন না। গত শনিবার রাজবাড়ীতে খালেদা জিয়া যে জনসভা করেছেন সেখানেও তিনি যাননি।
মওদুদ আহমেদ সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মমিনুর রহমান সুজন বাংলামেইলকে বলেছেন, ‘স্যার ইদানিং মামলাগুলো নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এছাড়াও অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি রাজবাড়ীর জনসভায় যেতে পারেননি।’
জানা মতে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার মওদুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বেঠকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন।
১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন মওদুদ আহমেদ। ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরে তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮১ সালের মে মাসে জিয়াউর রহমান নিহত হন এবং এক বছরের ভেতর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ এর নির্বাচনে মওদুদ আহমেদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। একবছর পর ১৯৮৬ সালে তাকে আবার উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৯ সালে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করেন।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে মওদুদ আহমেদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাঁচবার মওদুদ আহমেদ নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে নোয়াখালী থেকে পরাজিত হন তিনি। পরে বগুড়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বিএনপি গঠনে জিয়াউর রহমানকে সাহায্য করেছেন। এছাড়াও এরশাদের জাতীয় পার্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তার। পুরস্কার স্বরূপ জিয়া এবং এরশাদের আমলে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।