সান্তোস অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি তেল ও গ্যাস কোম্পানি। সম্প্রতি কোম্পানিটিকে অস্ট্রেলিয়ার পিল্লিগা নামক একটি গ্রামের কয়লা খনিতে দূষণের জন্য জরিমানা করা হয়েছে। আর এই ঘটনায় পিল্লিগা গ্রামের অধিবাসীরা সান্তোসের খনি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের ভাষ্য মতে, গ্রামের ক্ষেত ও খামারগুলোর একমাত্র পানির উৎসটিকেই দূষিত করে ফেলেছে সান্তোস। এতো গেল চলতি মাসের ১০ তারিখের ঘটনা। যদি আরো একটু পেছনে তাকানো যায় তাহলে এই খনি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অভিযোগের অনেক নজির পাওয়া যাবে। অনেক দেশের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার অগভীর সমুদ্রের ১১ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সান্তোসের সঙ্গে আরও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
সান্তোসের সঙ্গে পেট্রোবাংলার চুক্তিকে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের চুক্তি এর আগে ২০১২ সালেও হয়েছে। আবার করা হলো। এর মধ্যদিয়ে আমাদের গ্যাস পাওয়ার যে সম্ভাবনা তাকে রুদ্ধ করে দেয়া হলো। এ ধরনের চুক্তি কমিশনভোগী ছাড়া কেউই করতে পারে না। যারা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সুবিধা পায় তারাই কেবল অতি উৎসাহী হয়ে এ চুক্তি করেছে।’ একে বড় ধরনের দুর্নীতি করে দেশের সর্বনাশ করার একটা চুক্তি বলেও উল্লেখ করেন দেশের খনিজ সম্পদ রক্ষায় দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসা এই নেতা।
সান্তোসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এই কোম্পানির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তা থেকে তারা এখনো মুক্ত নয়। জনগণের কাছে তাদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। তাদের দায়িত্ব ছিল সেগুলো পরিষ্কার করা। কিন্তু তারা তা না করে আবারও চুক্তি করেছে। পেট্রোবাংলাসহ যারা এই চুক্তির সাথে জড়িত তাদেরও দায়িত্ব ছিল কোম্পানিটির অভিযোগগুলো পরিষ্কার না করা পর্যন্ত চুক্তি না করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুরো চুক্তিটাই জনগণকে না জানিয়ে তাদের বাইরে রেখে করা হয়েছে। এছাড়া এ চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়। এসব চুক্তি নিয়ে সংসদেও কোনো আলোচনা নেই। ফলে জনগণ জানতে পারছে না।’
যারা পেট্রো বাংলা ও বাপেক্স এ কর্মরত তারা মূলত জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে বলেই এসব চুক্তি জনগণের অজান্তে করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাইফুল হক।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘এটা সরকারের অতীতের পরিকল্পনারই ধারাবাহিকতার অংশমাত্র। সরকার তেল-গ্যাস উত্তোলনে নিজের সক্ষমতা না বাড়িয়ে বারবার বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে। এতে ক্রমান্বয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় এবং এক দল ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছে তারা মনে করে দেশের স্বার্থ জাহান্নামে যাক তারা তেল-গ্যাস পেলেই হলো। ফলে বিদেশি লুটপাটকারী এবং দেশি লুণ্ঠনকারীরা এ কাজগুলো করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এসব চুক্তি কখনও অসম আবার কখনও অসম্মানজনক স্বার্থে করা হচ্ছে। এ ধরনের চুক্তি জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পূর্ণই বিরোধার্থক। পেট্রোবাংলা এ ধরনের চুক্তিকে আইনি ফ্রেমে বেঁধে লুণ্ঠনকে বৈধ করতে চায়। আর তারই অংশ হিসেবে এ চুক্তি। এ ধরনের চুক্তির আড়ালে এক ধরনের লেনদেন হওয়ার ফলে জনগণের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থই প্রধান্য পায়।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানির এদেশীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ধারাবাহিকতা নব্বইয়ের দশক থেকেই চলছে। এ সরকারও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এ চুক্তি অবশ্যই জাতীয় স্বার্থবিরোধী, গণবিরোধী ও দেশ বিরোধী। এসব চুক্তির ফলে তেল-গ্যাসে জনগণের কোনো কর্তৃত্ব থাকছে না।’
২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসে সান্তোসের বিরুদ্ধে দেশটির জনগণ রাস্তায় নামে। কারণ ঠিক একমাস আগেই দেশটির সরকার এই বৃহৎ খনি কোম্পানিকে আটটি নতুন কূপ খননের অনুমোদন দেয়। কিন্তু প্রতিবাদকারীদের দাবি, সান্তোস কয়লা খনি থেকে বের হওয়া দূষিত পানি ঠিক কী উপায়ে পরিশোধন করবে তার কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য নেই তাদের চুক্তিপত্রে।
ওয়াইল্ডারনেস সোসাইটি নিউক্যাসলের মুখপাত্র নওমি হোগান বলেন, ‘কোম্পানিটি প্রতিদিন ৩৫ ট্রাক দূষিত পানি সিডনি শহরে নিয়ে আসে। পরবর্তী দিন তারা ওই ট্রাকগুলো আবার ভালো পানি দিয়ে পূরণ করে। এরপর তারা আবার ওসমোসিস খনিতে চলে যায়। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো তারা এই বিপুল পরিমাণ দূষিত পানি কী উপায়ে শোধন করে। যেহেতু সিডনিতে কোনো শোধনাগার নেই তাহলে কী তারা ওই দূষিত পানি সরাসরি পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে? তারা যদি কোনো নির্দিষ্ট পুকুরে ওই দূষিত পানি ফেলে দেয় তাহলে সেই পুকুরের পানি থেকে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হতে একটুও সময় লাগবে না।’
খনি কোম্পানি হিসেবে সান্তোস অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, বাংলাদেশসহ আরো অনেকগুলো দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সান্তোস ভারত থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে একপ্রকার বাধ্য হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, সান্তোস অগভীর সমুদ্র বক্ষে গ্যাস উত্তোলনের জন্য যে পদ্ধতি এবং সেই গ্যাস বিক্রির জন্য তৃতীয় পক্ষের যে প্রস্তাব দিয়েছিল তা যুক্তিযুক্ত ছিল না। এমনি অভিযোগ ভিয়েতনামেও ছিল।
সান্তোস তার ত্রিমাত্রিক সিসমিক সার্ভের মাধ্যমে সাঙ্গু-১১, দক্ষিণ সাঙ্গু ও মগনামা স্ট্রাকচারে গ্যাস প্রাপ্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশে। গ্যাসের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির বিষয়টি অনুমোদন না হলে গ্যাস উত্তোলন করবে না বলেও জানিয়ে দেয়। এখানে একটা প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক যে, গ্যাসের সঙ্কট লাঘবের কথা বলে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার অনুমতি দেয়ার যুক্তি কী? সান্তোসের ত্রিমাত্রিক জরিপ থেকে দেখা গেছে, মগনামা এবং দক্ষিণ সাঙ্গু ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৬টি গ্যাসের স্তর আছে যার প্রতিটিতে ৬২ থেকে ৭০ বিসিএফ (বিলিয়ন কিউবিক ফুট) গ্যাস আছে , এমনকি একটিতে ১৩০ বিসিএফ গ্যাসও পাওয়া যেতে পারে। এইসব গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস ঘাটতি দৈনিক ২৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট। অর্থাৎ এই ব্লক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান ঘাটতির প্রায় এক পঞ্চমাংশ মেটানো সম্ভব হতো যদি রাষ্ট্রীয় তদারকিতে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাতে গ্যাসটুকু বরাদ্দ করা সম্ভব হতো।
কিন্তু এখন এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পেট্রোবাংলা তথা জনগণ আর এই গ্যাসের ৮০ শতাংশ পাবে না কারণ এই চুক্তির ফলে সান্তোস আর তার ভাগের অংশ ২ দশমিক ৯ ডলার মূল্যে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করতে বাধ্য নয়। সে বাজারের যেসব কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দাম পাবে তাদের কাছেই গ্যাস বিক্রি করবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত টার্মে সমুদ্রের ১৬ নম্বর ব্লকের সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রকে প্রায় নিঃশেষ করে প্রচুর মুনাফা নিয়ে সান্তোস-হ্যালিবার্টনের কাছে ওই ব্লকের বাকি অংশটকু তুলে দিয়ে কেটে পড়ে বহুজাতিক কেয়ার্ন। এবার লুট করার পালা সান্তোস-হ্যালিবার্টনের। কেয়ার্নের মতো তাদেরও তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়। ঠিক তারই ধারাবাহিকতায় এবারও সেই আওয়ামী লীগ সরকারই সান্তোসের সঙ্গে অগভীর সমুদ্রের ১১ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আরও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলো।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর কেয়ার্নের কাছ থেকে সান্তোস ও হ্যালিবার্টন ১৬ নম্বর ব্লকের মালিকানা কিনে নেয়। বর্তমানে সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রের ৭৫ শতাংশ সান্তোসের এবং ২৫ শতাংশ মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি হ্যালিবার্টনের। এছাড়া ১৬ নম্বর ব্লকের ম্যাগনামা এবং হাতিয়া গ্যাস ক্ষেত্রের শতভাগ মালিকানা সান্তোসের।