বাংলাদেশের গরু চোরাচালানকারীরা এখন গরুর দাম হিসাবে নগদ টাকার বদলে ভারতীয়দের সোনার বিস্কুট দিচ্ছেন। শনিবার সে দেশের অন্যতম বাংলাভাষী পত্রিকা আনন্দবাজার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ভারতে সোনার দাম বাংলাদেশের চেয়ে ভরি প্রতি এক কিলোগ্রামে চার লক্ষ টাকা বেশি। আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরা পথে এক কিলোগ্রাম সোনা সে দেশে নিয়ে যেতে পারলে বাড়তি লাভ আরও প্রায় তিন লক্ষ টাকার।
সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই) প্রধান দাবি করেছেন, আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার করে নগদ বা হুন্ডিতে টাকা নেওয়ার চল চালু ছিল। ইদানীং সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন গরুর দাম হিসেবে ভারতীয়দের হাতে তুলে দিচ্ছেন সোনার বিস্কুট । এতে তাদের ব্যবসায় বেশ সুবিধা হচ্ছে। আগে বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে লক্ষ লক্ষ নগদ টাকা নিয়ে যাতায়াতে যথেষ্ট সমস্যা হতো। এছাড়া ধরা পরার ঝুকিও ছিল অনেক বেশি। তাই নগদ টাকার বদলে ছোট ছোট সোনার বিস্কুট, বার বহন করা তুলনায় অনেক সহজ।
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এসব সোনা আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কলকাতা বা মুম্বইয়ে বিক্রি করে দেন।
গত ছ’মাসে সীমান্ত রক্ষীদের হাতে প্রায় ১৫ বার ধরা পড়ছে সোনা পাচারকারীরা। কেবল উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, স্বরূপনগর সীমান্তে প্রায় ২০ কোটি টাকার সোনা এবং বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্তে ১৫ কোটি টাকার মতো সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে শুল্ক দফতর এবং বিএসএফ। কলকাতা বিমানবন্দরেও ধরা পড়েছে সোনা। দিন কয়েক আগে বসিরহাটে এবং বৃহস্পতিবার কলকাতার বড়বাজারে বহু টাকার সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে ডিআরআই। শুক্রবারেও স্বরূপনগরের হাকিমপুরে সোনাই নদীর পাড় থেকে ৫০০ গ্রাম সোনাসহ অসীম ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে বিএসএফ।
রাজস্ব গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার জানায়, গত শনিবার বসিরহাট থেকে সোনা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল বারিক বিশ্বাসকে জেরাকরে এ ব্যাপারে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। আব্দুল বারিক তাদের বলেছেন, সীমান্তে যারা গরু পাচারে যুক্ত ছিল, তারাই এখন সোনা পাচারে নেমেছে। উত্তর ২৪ পরগনার পাচারকারীরা কলকাতার বড়বাজার এবং মুম্বইয়ের বড় সোনার ব্যবসায়ীদের কাছে চোরাই সোনা বিক্রি করছে। এর সঙ্গে একটি বড় মাফিয়া চক্রও যুক্ত রয়ছে।
কিন্তু পুলিশ ও বিএসএফ কর্মকর্তাদের একাংশের মতে, যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়েছে, আর যে পরিমাণ সোনা পাচার হচ্ছে, তার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
এসডিপিও (বসিরহাট) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ধরা পড়া পাচারকারীদের জেরা করে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে একটা গরু যে টাকায় বিক্রি হয়, সেই টাকার সোনা এ দেশে চোরা পথে এনে বিক্রি করতে পারলে দুই দফায় লাভ হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে সোনার দাম বেশি। দ্বিতীয়ত, আমদানি শুল্কও ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।’
তবে এ রাজ্যের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একাংশ মনে করেন নতুন সরকারি আইন এবং শুল্ক বৃদ্ধির কারণেই বাংলাদেশ থেকে সোনা পাচার বেড়ে গেছে। ভারতে আগে নিয়ম ছিল, বিদেশ থেকে শুধু ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সোনা আমদানি করবে সরকার। ব্যাঙ্ক থেকে সোনা কিনে অলঙ্কার গড়ে বাজারে তা বিক্রি করবেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। সোনার আমদানি শুল্কও ছিল মাত্র ১ শতাংশ।
কিন্তু ভারত সরকার প্রায় এক বছর ধরে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সোনা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে । আমদানি শুল্ক বেড়ে হয়েছে ১০ শতাংশ। এ জন্যই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এখন সোনা কিনতে পারছেন না। আর বাজারে সোনার সেই চাহিদাকেই মূলধন করেছে সোনা পাচারকারীরা।
বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতি’র জেলা সভাপতি বিনয় সিংহ আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সোনা আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। আমদানি শুল্ক ১০ গুণ বেড়েছে। আমরা সোনা কিনব কোথা থেকে? সেই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে চোরাচালানকারীরা।’সংগঠনটির অভিযোগ, সরকারই সোনা পাচারের সুযোগ করে দিয়েছে।
ডিআরআই-এর গোয়েন্দারা এ অভিযোগ পুরোপুরি মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমান সরকারি বিধি হল এক কিলোগ্রাম সোনার অলঙ্কার বিদেশে রফতানি করলে, পরিবর্তে পাঁচ কিলোগ্রাম কাঁচা সোনা ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানি করা যাবে। তার মধ্যে চার কিলো বাজারে বিক্রি করা যাবে। কিন্তু পুঁজির কারণে ক্ষুদ্র স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটা অংশ স্বর্ণালঙ্কার বিদেশে রফতানি করতে পারেন না। আবার তাঁরা আমদানি শুল্ক দিয়ে সোনা কেনার ক্ষমতাও রাখেন না। ফলে, তাঁদের একাংশ পাচারকারীদের থেকে কম দামে সোনা কিনে তা দিয়ে ব্যবসা করছেন।
তবে পশ্চিমবঙ্গ স্বর্ণশিল্পী সমিতি’র বক্তব্য, আমদানির নীতির পরিবর্তন না হলে, সোনাপাচার চলতেই থাকবে।