ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির জয়ের সূচক ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হচ্ছে। ধেয়ে আসছে পরাজয়ের স্রোত। জনপ্রিয়তা বেশি তারপরও কেনো এই পরিণতি? আলাপকালে নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ দলটির হাইকমান্ডকেই দোষারোপ করছে। তাদের মত, তৃণমূল নেতাকর্মীদের পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিলে যোগ্য প্রার্থী দলীয় সমর্থন পেত। বহিষ্কারের তালিকাও দীর্ঘ হতো না। আর্থিক লেনদেননের অভিযোগও উঠতো না। নির্বাচনের ফলাফলও আশাব্যঞ্জক হতো। এক্ষেত্রে দলীয় চেয়ারপার্সনকে ভুল ম্যাসেজ দিয়েছেন বাছাই কমিটি। সামনের দিনগুলোতে আরো বিচক্ষণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে পরাজয়ের পাল্লা আরো ভারী হতে পারে।
অপরদিকে বিএনপি নেতাদের সাফ কথা, নির্বাচনী ঐক্যের শর্ত ভঙ্গ করেছে শরিক দল জামায়াত। সরকার দল অনেক উপজেলায় জবর-দখলের মচ্ছব করেছে। তারপরও বিশ্লেষণ করলে দেখা মেলে বিএনপি সমর্থিত অনেক প্রার্থীর জয়ের প্রধান বাধা শরিক দল জামায়াত। উভয় দলের প্রার্থী থাকায় ভোটের অংকে এগিয়ে জয় পেয়েছে সরকারদলীয় প্রার্থী। বিএনপিকে হারাতের আওয়ামী লীগের সহাযোগী হয়ে কাজ করেছে জামায়াত। নেতাদের দাবি জোটের একক প্রার্থী হলে তৃতীয়ধাপের নির্বাচনে অন্তত ১৫টি উপজেলায় তাদের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে জয় আসতো। এ নিয়ে গতকাল ফরিদপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এমন চিত্র তুলে ধরেছেন স্থানীয় বিএনপি। অভিযোগ করেছে, জামায়াতের কারণে বিএনপি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তারা জোটে থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে। তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে।
বহিষ্কারই একমাত্র পথ ছিল :
দলের যুগ্মমহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, রিজভী আহম্মেদ, সালাহ উদ্দিন আহমদসহ প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক কাজী আসাদকে দিয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করেছিলেন খালেদা জিয়া। এ কমিটিই নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, দলের জন্য নিবেদিত ব্যক্তিকেই সমর্থন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেক উপজেলায় তৃণমূলের মতামতকে আমলেই নেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে নির্বাচনী এলাকার সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা চাননি দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হোক। কারণ, তিনি জাতীয় নির্বাচনে তার পথের কাঁটা হতে পারেন। আবার মোটা অংকের লেনদেনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেকের ভাগ্যেই দলীয় সমর্থন জোটেনি। উল্টো তাকে দল থেকে ঝরে পড়তে হয়েছে।
দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে ইনকিলাবকে বলেন, নেতা তৈরি করতে অনেক সময় লাগে কিন্তু বহিষ্কার করতে এক টুকরো কাগজই যথেষ্ট। তিনি আরো বলেন, এই বিরোধ মেটাতে প্রয়োজনে দলীয় চেয়ারপারসনের কাছে প্রতিবেদন দেয়ার দরকার ছিল। কারণ, সমর্থনপ্রাপ্ত ও বিদ্রোহী প্রার্থী উভয়েই বিএনপির। নেত্রী একজনকে বললে অবশ্যই সেখানে একক প্রার্থী করা সম্ভব হতো। তৃণমূল নেতাদেরও প্রশ্ন তিলে তিলে গড়ে ওঠা বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী বহিষ্কারের ফলে দলের স্থানীয় কোন্দল আরো বাড়বে। প্রভাব পড়বে আগামীর আন্দোলনে।
হিসাবটা পাল্টে যেতো :
রাজনৈতিক আদর্শ নয়, শুধুমাত্র নির্বাচনী ঐক্যের জন্য জামায়াতের সাথে জোটে আবদ্ধ হয়েছে বিএনপি। সাথে রয়েছে আরো ১৭ শরিক দল। কিন্তু সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে উপজেলা নির্বাচনের হিসাবটা গরমিল হয়ে গেছে। ঐক্যের শর্ত পালন করলে সরকারদলীয় প্রার্থীর চেয়ে ১৯ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীর অংকটা আরো বাড়তে পারতো। জামায়াত সূত্র জানায়, অনুষ্ঠিত হওয়া তিনটি ধাপের নির্বাচনের মধ্যে প্রথমধাপে ১১৫ উপজেলায় জামায়াত প্রার্থী দেয় ২৭টি তাতে জয়ী হয় ১৩টিতে, দ্বিতীয়ধাপে ২৮ প্রার্থীর মধ্যে জয়ী হয় ৮টিতে এবার তৃতীধাপে ১৭টি উপজেলায় প্রার্থী দিয়েছিল। বিজয়ী হয়েছে ৮টিতে। তিনধাপে তাদের ৭২ প্রার্থীর মধ্যে জয়ী হয় ২৯টিতে আর পরাজিত হয়েছে ৪৩টি উপজেলায়। বিএনপির স্থানীয় নেতাদের দাবি সমন্বয় করে প্রার্থী দিলে ৪৩ উপজেলার ফলাফল ১৯ দলের ঘরেই উঠতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় জামায়াত-বিএনপির সমন্বয় না থাকায় বিজয়ী হয়েছেন সরকারদলীয় প্রার্থী। গত উপজেলা নির্বাচনে এখানে জামায়াত পেয়েছিল ১৬ হাজার ভোট। বিএনপির একাধিক প্রার্থী থাকায় জামায়াত এবার উপজেলাটিতে বিএনপির সমর্থন চায়। কিন্তু দলের ত্যাগী নেতা আলী আহম্মদ নাছুড় ছিলেন। দলের সমর্থন দাবি করেন আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে আসা এটিএম ফয়েজ। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট। বিরোধ মেটাতে বিএনপি নির্বাচনের দুদিন আগে আলী আহম্মদকে বহিষ্কার করে। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তিনি পেয়েছেন ২৩ হাজার ৫২৮ ভোট। জামায়াতের লোকমান আহমাদ পেয়েছেন ২৮ হাজার দুইশতাধিক ভোট। এখানে মহাজোট সমর্থক আবু জাহিদ ৩০ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
ফরিদপুর সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর ৮৪ হাজার ৯২৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী যুবদল নেতা মাহাবুবুল হাসান পিংকু পান ৬২ হাজার ৮৫৩ ভোট। দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ২২ হাজার ৭০ ভোট। এখানে জামায়াতের প্রার্থী আব্দুল তওয়াব পান ১৮ হাজার ৩৭৭ ভোট। হিসাবে মাত্র ৩ হাজার ৬৯৩ ভোটের ব্যবধানে সরকারদলীয় প্রার্থীর কাছে ১৯ দলকে হারতে হয়েছে। যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের আমজাদ হোসেন লাভলু ৮৯ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের দুই প্রার্থী। ১৯ দলের এই দুই প্রার্থী মিলে ভোট ছিল ৯১ হাজার ৮৯। একক প্রার্থী হলে ১৭ হাজার ৮৪ ভোটে বিজয়ী হতো। এখানে জামায়াতের গাজী এনামূল হকের ৭৫ হাজার ৮০৭ এবং সকাল ১০টায় বর্জন করে বিএনপির মশিউর রহমান ১৫ হাজার ২৮২ ভোট পান। এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। জামায়াতের দুরভিসন্ধির কারণে অন্তত ৪৫টি উপজেলা বেহাত হয়েছে। আর বিএনপির হাইকমান্ড বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিলে ফলাফল আরো ভালো হতো। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত শতাধিক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হতো না।