শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, কারখানার ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক নিরাপত্তায় কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, ভবন, বিদ্যুৎ এবং অগি্ন নিরাপত্তা নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরাঃ
শ্রমিকের নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, কারখানার ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক নিরাপত্তায় কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, ভবন, বিদ্যুৎ এবং অগি্ন নিরাপত্তা নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে পোশাকশিল্পের মালিকরা। এর ওপর বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটির তৎপরতায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে পোশাকশিল্প। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিদেশি পোশাক ক্রেতারা। তবে তাদের ফিরিয়ে আনতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিজিএমইএ।
গত কয়েক মাসে যেসব রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশ থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে, সেগুলোর কিছু অংশ আবার ফিরিয়ে আনারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ রপ্তানি আদেশ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিদেশি ক্রেতারা। অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে পোশাকের মূল্য বেশি হওয়া সত্ত্বেও ভারত ও ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশে এই আদেশ দেয়া হয়েছে। ওইসব আদেশ বাতিল করে দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে ক্রেতাদের রাজি করাতে বিজিএমইএ চেষ্টা করছে।
বিজিএমইএ'র তথ্য মতে, হরতাল-অবরোধে গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪৭ দিন শ্রমিকরা কাজ করতে পারেনি। আদেশ বাতিল, মূল্যছাড়, এয়ারফ্রেইট, শিপমেন্টে বিলম্ব এবং পণ্য জাহাজীকরণের বাড়তি খরচসহ নাশকতায় ক্ষতির মুখে পড়ে পোশাকশিল্প। তাতে শিল্পের চেইন অব কমান্ড ধসে যায়। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া ও ক্রেতাদের আস্থা কমে গিয়ে রপ্তানি আদেশ স্থানান্তর হয়েছে। এখন ক্রেতা ও অর্ডার ফিরিয়ে আনতে সংগঠনটি জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর ওপর বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটির তৎপরতায় বেকায়দায় পড়েছে পোশাকশিল্পের মালিকরা। ইতোমধ্যে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরামর্শে বেশ কিছু ক্রুটিপূর্ণ কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আরো কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ১১ মার্চ পোশাক কারখানা পরিদর্শনের প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুরের ভিয়েলাটেক্স লিমিটেড ৭ তলার অনুমোদন নিয়ে ৯তলা কারখানা করেছে। কারখানার ইউনিট ১-এর ভবনের বিম ও কলামে আছে অনেক ফাটল। নিটিং ও ডাইংয়ের ছাদের কাঠামো মজবুত নয়। এ ছাড়া বের হওয়ার তিনটির মধ্যে দুটি সিঁড়িই নিচতলায় ভবনের ভেতর গিয়ে শেষ হয়েছে। অ্যাকর্ড পরিদর্শন করে এই ত্রুুটিগুলো খুঁজে পেয়েছে। পরিদর্শনে ভিয়েলাটেক্সের কারখানা ভবনের কাঠামোগত ৭, অগি্ন ৩৫ এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তাবিষয়ক ৩১টি সমস্যা চিহ্নিত করেন অ্যাকর্ডের প্রকৌশলীরা। সূত্র মতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে ১০টি কারখানা পরিদর্শন করে অ্যাকর্ড। এগুলো হচ্ছে আলিফ গার্মেন্ট, আনলিমা টেক্সটাইল, বিগ বস করপোরেশন, ড্রাগন সোয়েটার বাংলাদেশ, ফ্যাশন আইসল্যান্ড, গ্রামীণ নিটওয়্যার, মজুমদার ফ্যাশন্স, রেড পয়েন্ট জ্যাকেটস, রিও ফ্যাশনওয়্যার অ্যান্ড রিও ডিজাইন এবং ভিয়েলাটেক্স। পরিদর্শনের সময় ভবনের অবকাঠামোগত দিক, অগি্ন ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় নিরাপত্তার জন্য হুমকি_ এমন ত্রুটি চিহ্নিত করে প্রতিটি কারখানার জন্য আলাদা ৩টি করে মোট ৩০টি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে প্রতিকার বা সংস্কার করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে গুরুত্বভেদে ৩-৬ মাস পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অ্যাকর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী ৬ মাসের মধ্যে প্রায় ১৭০০ কারখানা পরিদর্শন শেষ হবে। পুরো কার্যক্রমটি চলবে ৫ বছর। একসঙ্গে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের ৩৮টি দল পরিদর্শনের কাজ করছে।
এখন পর্যন্ত ৭৮ কারখানার পরিদর্শন শেষ হয়েছে। সর্বশেষ ইউরোপীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশের পরিদর্শকরা মিরপুরে সফটেক্স ও ফেম নামের দুটি পোশাক কারখানা ভবনে ত্রুটি পায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মার্চ থেকে কারখানা দুটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ জানায় পরিদর্শকরা। সূত্র মতে, মিরপুরের হাজি কুদরাত আলী মোল্লা সুপার মার্কেটের ৮ তলা ভবনের ৫ থেকে ৮ তলায় রয়েছে সফটেক্স কটন প্রাইভেট লিমিটেডের কারখানা। আর ১ থেকে ৪ তলায় রয়েছে ফেম গ্রুপের কারখানা। সুইং মেশিনসহ গুদামজাত পণ্যের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভার বহন করছে সফটেক্স গ্রুপের কারখানা। এই ভার বহনের যথেষ্ট সামর্থ্য রাখে না ভবনের কলাম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুটি কারখানাই আপাতত উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। জানা যায়, অ্যাকর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানা মূল্যায়ন কার্যক্রম করার ঘোষণা দেয় গত মাসে। এর আগেই তারা মোট ১১০টি কারখানা পরিদর্শন শেষ করেছে। আর এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ফলাফলের ভিত্তিতেই একের পর এক কারখানা খালি করার সিদ্ধান্ত জানতে পারছেন মালিকরা। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স মনোনীত স্কটিশ প্রতিষ্ঠান অরূপ, ডবিস্নউএসপি ও হিউজ অ্যাসোসিয়েট্স এই মূল্যায়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর আগে জিন্স কেয়ার লিমিটেড নামের একটি কারখানার ভবনে স্থাপত্য ত্রুটির কারণে কারখানা খালি করার অনুরোধ করে অ্যাকর্ড। পরে সরকার মনোনীত রিভিউ কমিটির পরামর্শে সংশোধন কার্যক্রম বাস্তবায়নে শর্ত পূরণ করে কারখানা কার্যক্রম চালু রাখার অনুমতি পায় তারা। অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশের আওতায় কারখানা সংখ্যা প্রায় ১৮০০টি। এ ছাড়া উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্সের কারখানা সংখ্যা প্রায় ৮০০। এর মধ্যে দুই জোটের অভিন্ন কারখানা বাদ দিয়ে মোট কারখানা সংখ্যা প্রায় ২৩০০, যার প্রায় ২০-৩০ শতাংশ শেয়ার্ড ভবনের ভাড়া দিয়ে পরিচালিত হয়। রানা প্লাজা ধসের কারণে এ ধরনের কারখানাগুলো মূল্যায়নে ক্রেতারা অনেক বেশি কঠোর ও সচেতন অবস্থান নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। একইভাবে বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি সম্প্রতি এক জরিপ চালিয়েছে। জরিপে বলা হয়, তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বলেছেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।
এগুলো হচ্ছে কারখানার ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধায়কদের প্রশিক্ষণের অভাব, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ভুল আচরণ এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের অভাব। অবশ্য জরিপে ৪৬৭ জনের মধ্যে ৬৪ শতাংশ কারখানার মালিক ছাড়াও এতে অংশ নেয় ১৮ দশমিক ১ শতাংশ ব্র্যান্ড ও ৪ দশমিক ৭ শতাংশ পরামর্শ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং ২ দশমিক ৮ শতাংশ উন্নয়ন কর্মী। এদিকে কমপ্ল্যায়েন্সের নামে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে বলে বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। গত ৯ মার্চ এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বিজিএমইএ'র দ্বিতীয় সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি। মান্নান কচি বলেন, কমপ্ল্যায়েন্সের নামে দেশের পোশাকশিল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। নিরাপত্তার নাম করে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে দেশের অনেক পোশাকশিল্প-কারখানা। এর ফলে বেকার হয়ে পড়ছেন অনেক শ্রমিক।
এ বিষয়ে সরকার যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। ওই সভায় বিজিএমইএ'র সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা সরিয়ে নেয়ার অতিরিক্ত সময় দেয়ার কথা থাকলেও অ্যাকর্ড তা দিচ্ছে না। হঠাৎ করে নির্দেশ দিচ্ছে কারখানা বন্ধ করে দিতে। সরকারের সঙ্গে তাদের যে চুক্তি হয়েছে, তা তারা লঙ্ঘন করছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি ও ইএবির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী দৈনিকপ্রথম বাংলাদেশ কে বলেন, পোশাকশিল্প টিকিয়ে রাখা এখন বিগ চ্যালেঞ্জ। সরকার-মালিক-শ্রমিক এক সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কারণ শ্রমিকের নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, কারখানা কম্পস্নায়েন্স করা, শ্রমিক নিরাপত্তায় কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, ভবন, বিদ্যুৎ এবং অগি্ন নিরাপত্তায় অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি এই সেক্টরের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সালাম মুর্শেদী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও একটা প্রবৃদ্ধি ছিল। তখন যে অর্ডার ছিল, তা আকাশ পথে ও জাহাজে যেভাবে পেরেছি পণ্যগুলো পাঠিয়েছি। সে সময়ের প্রভাব এখন পড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে ক্রেতারা অর্ডার দিচ্ছে না।
মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুনের অর্ডার আগের মতো আমরা পাচ্ছি না। দিন যত যাচ্ছে, রপ্তানি ততই কমছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স কারখানা পরিদর্শন শুরু করেছে। এর আগেও বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ড আমাদের দেশে তাদের যে থার্ট পার্টি আছে, যেমন আইপিএস, বিভিএস তাদের দিয়ে কারখানা পরিদর্শন করিয়েছে। ইলেট্রিক্যাল ও অবকাঠামোগত বিষয়ে পরিদর্শন করিয়েছে। সেখানেও কিছু কিছু সমস্যা ছিল। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স এসেছে পোশাক খাতের উন্নয়নের জন্য। তাদের উচিত হবে এমন কিছু না করা, যাতে এই শিল্পের ক্ষতি হয়। তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এমতাবস্থায় শিল্প কারখানাগুলো টিকিয়ে রাখতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।