সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য দলের রণকৌশলকে দায়ী করেছেন ঢাকা মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। তিনি বলেন, আন্দোলনকেই একমাত্র এজেন্ডা করে মাঠে নামা উচিত ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন, একসঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়ার কারণেই তারা ব্যর্থ হয়েছেন। আন্দোলনে ঢাকা মহানগরের ব্যর্থতা ও কমিটি না হওয়ার জন্য প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপকে দায়ী করে তিনি বলেন, সময়ের কারণে এখন নতুন নেতৃত্বেরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সে জন্য এ পদ থেকে তিনি অব্যাহতি চেয়েছেন।
তিনি বলেন, এই সরকারকে হটাতে বিএনপিকে নতুন কৌশলে আন্দোলন শুরু করতে হবে। সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী ও সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বৃহস্পতিবার তার গুলশানের বাসায় দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকার সাবেক এই মেয়র। এরপর কারাগারে কেটেছে দীর্ঘ আড়াই মাস। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান তিনি। এরপর অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় না হলেও আন্দোলনে নিহত ও নিখোঁজ নেতাকর্মীদের বাসায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সময় দিচ্ছেন নেতাকর্মীদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কর্মীদের কথা শুনছেন মনোযোগ দিয়ে। চেষ্টা করছেন সমাধানের, কিংবা আশ্বস্ত করতে। এ বিষয়ে তিনি বলেন রাজনীতিতে বিশ্রাম বলে কিছু নেই।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সারাদেশের আন্দোলন সফল হলেও রাজধানীতে বিএনপি কিছু করতে পারেনি বলে অভিযোগ ওঠে। এ জন্য আঙুল ওঠে সাদেক হোসেন খোকার দিকে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থ মহানগর বিএনপি। এ সময় তিনি মহানগর কমিটি পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন। এসব ঘটনায় অনেকটা অভিমান করেই গত ১২ মার্চ ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি থেকে অব্যাহতি নেয়ার ঘোষণা দেন সাদেক হোসেন খোকা। তিনি বলেন, কে ব্যর্থ আর কে সফল তা নিয়ে দলের মধ্যে দোষারোপ চলছে। একজনের দোষ আরেকজনের ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই সাদেক হোসেন খোকা বলেন, তাদের ভুলত্রুটি যে একেবারেই নেই তা নয়। এরপর তিনি আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেন ছাত্র সংগঠনকে। তিনি বলেন, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রধান ও মুখ্য ভূমিকা রাখে দেশের ছাত্রসমাজ। তারা আন্দোলন শুরু করে, পরে সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সব পেশার মানুষের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে তাদের ছাত্রসমাজকে কাজে লাগানো যায়নি। নিজের পদ থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি চাওয়া প্রসঙ্গে খোকা বলেন, ঢাকা মহানগর বিএনপিকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সময় এসেছে। তাই বিএনপি চেয়ারপারসনকে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। আশা করছেন তিনি তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করবেন।
সাড়ে ১৭ বছর ধরে ঢাকা মহানগর বিএনপিতে তিনি সভাপতি, আহ্বায়কসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ফলে এখন সময় হয়েছে পুনর্গঠনের ও নতুন নেতৃত্বকে সৃষ্টি করার। ঢাকা মহানগর বিএনপির পরবর্তী কমিটি প্রসঙ্গে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, প্রথমে তিনি চেয়ারপারসনের কাছে দলের ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্ব দিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। রাজি না হলে উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর নাম প্রস্তাব করেন। তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি না হলে স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহের নাম প্রস্তাব করেন। মির্জা আব্বাস ও আবদুল আউয়াল মিন্টু ওই পদ গ্রহণে ইতোমধ্যে অসম্মতি জানিয়েছেন। আলাপচারিতায় তার ভেতর এক ধরনের অভিমান ও ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেলেও তিনি অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। মহানগর কমিটি থেকে তার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে যেমন একটি পক্ষ খুশি হয়েছেন, তেমনি খোকার সমর্থিত নেতাকর্মীরা আশাহত হয়েছেন। তারা মনে করেন, দলের কিছু নেতার অসহযোগিতা আর দোষারোপের রাজনীতির কারণে আজ তাকে এই পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা বলেন, মহানগর বিএনপিকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য দলের ভেতর থেকেই একটি চক্র কাজ করেছে। ঢাকার আন্দোলনের জন্য মূলত মহানগর ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের মতো সংগঠনের ওপর নির্ভর করা হয়। কিন্তু তাদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন ওয়ার্ডের উদাহরণ দিয়ে খোকা বলেন, একসঙ্গে আন্দোলন আর নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়ার কারণে নেতাকর্মীরা মাঠে নামেননি। যারা দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন তারা মাঠে নামার চেষ্টা করেছেন। অন্যরা এক্ষেত্রে বাধা দিয়েছেন বা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এ কারণে সারাদেশসহ মহানগরের এ অবস্থা। এ ছাড়া মহানগরের সব কমিটি বিভিন্ন নেতানির্ভর গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তাদের কোনো নেতাকর্মীকে আন্দোলনে পাওয়া যায়নি। তারা কারো সঙ্গে সমন্বয় করেননি।
আন্দোলন ব্যর্থতার জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মহানগর বিএনপির বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সরাসরি হস্তক্ষেপ হয়েছে। যার কারণে অধিকাংশ এলাকায় কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। বলা হয়ে থাকে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া ওই নির্বাচনে ৫ ভাগ মানুষও ভোট দিতে যাননি। এই যে অধিকাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাননি সেটিও আন্দোলনের সফলতা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল এটা তারই সফলতা। দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে আন্দোলনে ঢাকা মহানগর কেন পিছিয়ে ছিল জানতে চাইলে খোকা বলেন ঢাকায় আন্দোলন হয়নি বলা যাবে না। সারাদেশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। দেশের ৯০ ভাগ এলাকা ছিল ১৯ দলের দখলে। আরেকটি বিষয় হলো_ ঢাকা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। তাই সব শাসকই ক্ষমতার কেন্দ্রকে সুরক্ষিত করতে চায়। এখানে প্রশাসনের নজরদারি সবচেয়ে বেশি থাকে। সরকারের বিভিন্ন সমালোচনা করে তিনি বলেন, যে সরকার যত অত্যাচারী হয়, তার বিদায়ও তত নির্মম হয়। ভোটারবিহীন নির্বাচনের এই দখলদার সরকারকেও ক্ষমতা থেকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। যা সময়ের ব্যাপারমাত্র। এ জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে। সাংগঠনিক সব দুর্বলতা কাটিয়ে দলকে আন্দোলনমুখী করতে হবে। ঢাকা সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা এখনো ডিসিসি ভাগ করার বিপক্ষে। তবে নির্বাচন হলে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অংশ নেয়া হবে। এমনকি স্থানীয় সব নির্বাচনে দল অংশ নেবে বলে তিনি মনে করেন।
কারণ এটা আন্দোলনের একটি অংশ। ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি ব্যর্থতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ওইদিনের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে তা ঠিক নয়। সরকার দেখামাত্রই বিএনপি নেতাকর্মীদের গুলির নির্দেশ দিয়েছে। দখলদার সরকার যেভাবে আচরণ করে এ সরকারও সেভাবে তাদের সঙ্গে আচরণ করেছে। এখন তাদের মোকাবেলা করতে হলে নতুন করে ভাবতে হবে, কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কবে নাগাদ সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন প্রশ্নের জবাবে খোকা বলেন, দিন-তারিখ ঠিক করে কখনো আন্দোলন হয় না। তাছাড়া বিএনপি কোনো বিপ্লবী পার্টি নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক পার্টি। তবে শিক্ষাঙ্গন থেকেই প্রথমে এ আন্দোলনকে আরো গতিশীল করে তুলতে হবে। তারপর সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। আন্দোলন সফল করার ব্যাপারে যুক্তি তুলে ধরে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করেছিল। এই সরকারও আন্দোলন দমাতে বিএনপির সক্রিয় কর্মীদের হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার-নির্যাতন আর হয়রানি করছে।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৪ মে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক করে ২১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। দীর্ঘ তিন বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না পারা তার ব্যর্থতা কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে ছিলেন। প্রতিনিয়ত তাদের কোনো না কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। এছাড়া সরকারের নির্যাতনের কারণে তারা নিয়মিত দাপ্তরিক কোনো কাজও করতে পারিননি। তাই সংগঠনকে ঠিকমতো গোছানো সম্ভব হয়নি। মন্ত্রীদের আগামী ৫ বছর ক্ষমতা থাকার ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগণের সমর্থন লাগে। জনসমর্থন না থাকলে ক্ষমতায় থাকতে চাওয়াটা অন্যায় আবদার। মানুষ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্যদিয়েই অনাস্থা দিয়ে ফেলেছে। এখন এই সরকারের কোনো বৈধতা নেই। উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি আরো ভালো করত। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ৫টি আসনও পেত না। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন এই কঙ্কালসার সরকার বাস্তবতা না বুঝে জনগণের ওপর এখনো নির্যাতন করছে। ভোটকেন্দ্র দখল করে বিজয় ছিনিয়ে নিচ্ছে।