দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস আর অনাস্থা রাজনীতিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, এ সংস্কৃতি সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে, সুযোগ করে দিচ্ছে স্বার্থান্বেষী তৃতীয়পক্ষকে। দলীয়করণ যখন রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল আজ্ঞাবহ করে দিয়েছে, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ সেই দেশে নির্বাচন পরিচালনার কাজটা যে কতো কঠিন তা বোধহয় টের পেয়েছেন কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ।
বিএনপির মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে ছাড়াই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জে উৎরে গেছেন এটা সম্ভবত সিইসি নিজেও বিশ্বাস করেন না। এরপরই শুরু হলো উপজেলা নির্বাচন। পাঁচ দফার মধ্যে প্রথম দুই দফা শেষ করেই দেশ ছাড়লেন তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই নির্ভর করছে তখন নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের প্রধান অভিভাবক যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলেন কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই।
রকিবউদ্দিন আহমদের দেশ ছাড়ার পরেই গুঞ্জন ওঠে যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ক্ষমতাসীনদের চাপ সইতে না পেরে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন তিনি। কিন্তু দেশে না থাকলেও তো পদে আছেন। তাই বিদেশেও হয়ত অস্বস্তি পিছু ছাড়ছে না। তাই শোনা যাচ্ছে তিনি নাকি আর এ আমলে দেশে ফিরছেন না। সেখান থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ আর দায়িত্বে থাকছেন না এমন গুঞ্জন খোদ নির্বাচন কমিশনেই চাউর হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা তো নিশ্চিত হয়ে বসে আছেন!
সূত্র জানায়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিহীন ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন নিজেও অস্বস্থির মধ্যে ছিলেন। মুখে সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কথা বললেও এ নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন না তিনি। এ কারণে সংসদ নির্বাচনের আগেও তিনি পদত্যাগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গৃহিত না হওয়ার আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত পদত্যাগপত্র জমা দেননি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নির্বাচন পরিচালনা করেছেন।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার সিইসির একান্ত সচিব (পিএস) একেএম মাজহারুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক। এতে সিইসি দেশে না ফেরার আশঙ্কা আরো ঘনীভূত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশন সচিবলায়ের এক কর্মকর্তা বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমরা যতুটুক জানি তিনি (সিইসি) আর দেশে ফিরবেন না। এছাড়া ছোট্ট একটি কারণে সিইসি স্যারের পিএসকে বরখাস্ত করায় এ অশঙ্কায় আরো বেড়ে গেছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্যার (সিইসি) আমেরিকা থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে পারেন। যেমন করে সোহেল তাজ বিদেশ থেকে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছিলেন।’
গত ৩ মার্চ ব্যক্তিগত সফরের কথা বলে এক মাসের ছুটিতে নিউইয়র্কে গেছেন সিইসি। উপজেলা নির্বাচনের মাঝখানে ছুটিতে যাওয়ায় ওই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে মিডিয়াতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ এমনিতেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে জাতির কাছে অত্যন্ত বিতর্কিত। তার ওপর উপজেলা নির্বাচনে মাঝখানেই সস্ত্রীক বিদেশগমন যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
অনেকে বলছেন, বর্তমান সঙ্কটের দায় এড়াতে পারেন না কাজী রকিবউদ্দিন। প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখেই ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রাধান নির্বাচন কমিশনার। অথচ প্রধান দুই দলের সমঝোতার জন্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা এখতিয়ার তার ছিল। এরপর থেকেই বিরোধী দলের সহিংস প্রতিরোধ কর্মসূচি। সারাদেশে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। এর জন্য অবশ্য বিরোধী দল কম সমালোচিত হয়নি।
এছাড়া বহুল বিতর্কিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করা হয় এ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কমপক্ষে তিন বছর সক্রিয় রাজনীতি করার শর্ত তুলে দেয়া হয়। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে জেলা প্রশাসক না রাখার প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়। এতে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এবং নির্বাচনকে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়। তুমুল সমালোচনার মুখে সংশোধিত আরপিও সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়।
এরপরই কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন। এ আইনটি বাতিল হওয়ায় দলের গণতন্ত্র নষ্ট হবে এবং প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবেন বলে বিষেজ্ঞরা মত দেন। এছাড়া নির্বাচনে কালোটাকার দৌরাত্ম্য এবং মনোনয়ন বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলেও নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকালে সিইসি জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন,‘নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া কাজের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেবে বলে তিনি কথা দিয়েছিলেন। নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে সর্বোচ্চ সতর্কতা স্বরূপ সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, আনসার নামানো হয়েছিল।
কিন্তু সহিংসতা ঠেকানো যায়নি। বিরোধী দলের নির্বাচন ঠেকানোর কর্মসূচিতে যেমন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তেমনি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পরও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জালভোট, জোরপূর্বক ভোট, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন।
এছাড়া ভোটের আগের দিন রাতে নির্বাচনী এজেন্টকে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। ভোটের দিন সহিংসতায় নিহত হয়েছে ১৯ জন। কিন্তু তারপরও নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ১৯ জন নিহত ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনেও সহিংসতা ও ভোট কেন্দ্র দখল, জালভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জোরপূর্বক ভোট প্রদান, ভোটকেন্দ্রে গোলগুলির ঘটনা চলছেই। নির্বাচন কমিশন যতোই বলুক, তাদের সফলতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে।