দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ এক্সক্লুসিভঃ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান গাবতলীতেই হারতে বসেছে বিএনপি। বহুমুখী কোন্দল আর বিভক্তির কারণে সেখানে বিএনপির প্রধান শত্রু এখন বিএনপি। সাধারণ ভোটার ও সমর্থকদের মধ্যে বাড়ছে শঙ্কা। জেলা ও উপজেলা নেতারা বিদ্রোহীদের না দমিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্র দখল ও হামলার পরিকল্পনার ধূয়া তুলছেন।
দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিজের আসনের এ উপজেলায় বিদ্রোহী ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। দলের একক প্রার্থী ঘোষণার কিছুদিন পরে অপর এক বিদ্রোহীকে কেন্দ্র থেকে সমর্থন দেয়ায় ঘটনায় ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চাঙা হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষ দলের একক প্রার্থী।
চতুর্থ দফায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আগামী ২৩ মার্চ গাবতলীতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির সবচেয়ে বড় এ ভোটব্যাংকে চার প্রার্থী মিলে এবার ভাগ বসাচ্ছেন। অথচ প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের পক্ষে একক প্রার্থী দিয়ে জয় তুলে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সিনিয়র নেতারা।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার জন্মস্থানে ক্ষমতাসীন দলের একক প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম আজম খান। তিনি এর আগে মাত্র ২ হাজার ৪৯৫ ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষ বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন। এবার বিদ্রোহী ভারাক্রান্ত বিএনপিকে ঠেকিয়ে জয় তুলে নিতে সিনিয়র ও প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এদিকে, চেয়ারম্যান পদে একে অপরের বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন বিএনপির চার নেতা। এরা হলেন- বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম হেলাল, বর্তমান পৌরমেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ মিল্টন, থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক নতুন এবং বালিয়াদিঘী ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম ভূ-ধন।
দলীয় সূত্রমতে, বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে চারপ্রার্থীর মধ্যে প্রথমে দলীয় সমর্থন পান বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম হেলাল। সমর্থন পেয়ে তিনি জেলার শীর্ষ নেতাদের নিয়ে প্রচারণার মাঠে নামেন। এসময় অপর দুই প্রার্থী কিছুটা নীরব হয়ে গেলেও মাঠে সক্রিয় থাকেন মোরশেদ মিল্টন।
এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত পৌর মেয়র মিল্টন বলেছিলেন, ‘আমার জানা মতে, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) এখনো গাবতলীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই মেনে নিব।’
এর মধ্যে হঠাৎ করেই কেন্দ্রের নির্দেশে দলীয় সমর্থন পরিবর্তন করা হয়। মোরশেদ মিল্টনই পেয়ে যান দলীয় সমর্থন। জেলা বিএনপির সভাপতি ও তারেক রহমানের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ভিপি সাইফুল ইসলামের নির্দেশে গত ১৬ মার্চ জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মাহফুজার রহমান রাজু এক বিবৃতিতে গণমাধ্যমে এ তথ্য জানিয়ে দেন। এখবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার আনাচে কানাচে। প্রার্থী পরিবর্তনের খবরে মিল্টন সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়লেও নাখোশ হয় হেলালের কর্মী-সমর্থকরা।
এর আগে ২০০৯ সালে গাবতলী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি সমর্থিত জাহিদুল ইসলাম হেলাল ৫৪ হাজার ৬৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। মাত্র ২ হাজার ৪৯৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন এএইচএম আজম খান। তিনি পেয়েছিলেন ৫১ হাজার ৫৭১ ভোট। তৃতীয় স্থানে থাকা জাতীয় পার্টির আমিনুল ইসলাম সরকার পিন্টু পেয়েছিলেন ২১ হাজার ১২৭ ভোট।
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতি সম্মান জানিয়ে গাবতলী উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছে জামায়াত। গত ২০ মার্চ বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা নেতারা একথা জানায়। তাদের দাবি অনুয়ায়ি তাদের প্রায় ৪০ হাজার রিজার্ভ ভোট বিএনপির বাক্সে পড়বে। তবে বিদ্রোহীদের মধ্যে এ ভোট ভাগাভাগি হলে জয় তোলা নিয়ে বিপদে পড়তে পারে বিএনপি।
জামায়াত নেতাকর্মীরা জানিয়েছে, তারা কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। এক্ষেত্রে বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দুইজনই পাবেন জামায়াতের ভোট।
জামায়াতের সিংহভাগ ভোটই মিল্টন পাবেন বলে মনে করেছে দলের সর্বশেষ সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকরা। তাদের দাবি, রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে জামায়াতের সাথে বেশি যোগাযোগ ছিল মিলটনের। বিপরীতপক্ষে হেলাল সমর্থকরাও দাবি করছেন, জামায়াতের ভোট শেষ পর্যন্ত তাদের বাক্সেই পড়বে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর না হলেও ভালো মানুষ হিসেবে হেলাল পরিচিত। এ বিবেচনায় তিনি ভোট পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করছেন তার সমর্থকরা।
থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক নতুন ও বালিয়াদিঘী ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য ও সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম ভু-ধন এখনও সমান তালে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ দুই প্রার্থীর নিজ নিজ অঞ্চলে জামায়াতের ভোট তাদের বাক্সে পড়বে বলে মনে করছে তারা।
এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী না থাকায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। জাপা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোট আজমের বাক্সেই পড়বে এমন দাবি পার্টির সমর্থকদের।
এদিকে, উপজেলার ৯০টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ১৫-২০টি দখল করে সরকারদলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করা হতে পারে বলে এলাকায় গুজব রটেছে। এতে ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। বৃহস্পতিবার জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল সংবাদ সম্মেলন করে এমন আশঙ্কার কথা বলেছেন।
তবে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে একক প্রার্থী না দেয়া ও বিদ্রোহীদের দমন করতে না পারার দুর্বলতা আড়াল করতেই নেতারা নানা আশঙ্কার কথা বলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা জানান, দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জেষ্ঠ্যপুত্র তারেক রহমান কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্ব পাওয়ার পরেই বগুড়ায় তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ একটি গ্রুপ তৈরি হয়। এ গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে জেলার সিনিয়র নেতাদের তৈরি হয় দূরত্ব। এখান থেকেই শুরু হয় প্রবীণ-নবীনে দ্বন্দ্ব। অনেকেই এ দ্বন্দ্বকে খালেদাপন্থি ও তারেকপন্থিদের স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
দলীয় সূত্রমতে, তথাকথিত খালেদাপন্থিরা বর্তমানে অনেকটা নীরব হয়ে যাওয়ায় তারেকপন্থিরাই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বগুড়া বিএনপির। এসব নেতাদের কাছে এখন লন্ডনের নির্দেশই চূড়ান্ত। তবে প্রবীণ ও সিনিয়র নেতাদের দাবি এখন উপেক্ষা করতে পারছে না কেন্দ্র কমিটি। আর এনিয়েই দেখা দিয়েছে নানা বিভ্রান্তি।
সূত্রমতে, জেলা সভাপতির কাছের লোক হিসেবে পরিচিত জাহিদুল ইসলাম হেলালকে প্রথম দলীয় সমর্থন দেয়া হয়। পরে চেয়ারপারসনের নির্দেশে মাঠ যাচাই করে সমর্থন পরিবর্তন করে দেয়া হয় মোরশেদ মিল্টনকে। কেন্দ্রের এ নির্দেশ বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেও মাঠে কারো পক্ষে জোরালো ভাবে দেখা যায়নি জেলা সভাপতি সাইফুল ইসলামকে।
তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণার মাঠে নেমেছেন জেলার শীর্ষ নেতারা। এ তালিকায় রয়েছেন একসময়ের দাপুটে রাজনীতিক জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি টিএম মুসা পেস্তা। তার সঙ্গে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ধন্য গোপাল সিংহ এবং বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রফি নেওয়াজ খান রবিন। তারা কখনও যৌথভাবে কখনও এককভাবে গণসংযোগ করছেন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি হওয়ায় গাবতলী উপজেলায় উপজেলা বা জাতীয় নির্বাচনে বেশি সুবিধা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নেতারা।
বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান বলেন, কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। তবে আর নয়, গাবতলীতে অবশ্যই আমাদের বিজয় হবে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে দেশের রেকর্ড ভোট পেয়ে বিজয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। পরে এ আসনের উপ-নির্বাচনে এমপি (জাতীয় সংসদ সদস্য) নির্বাচিত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রভাবশালী এ নেতা বেশির ভাগ সময় ঢাকায় কাটানোর ফলে এ আসনের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেয়া হয় বেগম খালেদা জিয়ার আত্মীয় হিসেবে পরিচিত সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান লালুকে। দায়িত্ব পেয়েই তিনি বিতর্কের সৃষ্টি করেন।
তৎকালীন দলের জেলা আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে লালুর সুসম্পর্কের সূত্রধরেই সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক (বর্তমানে জেলা সভাপতি) সাইফুল ইসলামের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সিনিয়রগ্রুপের নেতা লালুর সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের নেতা সাইফুলের নীরব কোন্দল শুরু হয়।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে এমপি লালু পুরো গাবতলী উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নেন। তিনি বিভিন্ন জনসভায় প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের ঘরে কোনো বিয়ে নয়। এমনকি যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি সমর্থন করেন তাদের সাথে কোনো ধরনের আত্মীয়তা না করতেও নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসময় মোরশেদ মিল্টন সাইফুলের পক্ষের লোক হিসেবে চিহ্নিত হলেও পরবর্তীতে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে সাবেক এমপি লালুর সঙ্গে।
গত ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গাবতলী থানা ও পৌর বিএনপির সম্মেলনের দিন ধার্য করা নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন পৌরমেয়র মোরশেদ মিলটন ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম হেলাল। এরপর থেকেই দুজনের মধ্যে চলছে চরম বিরোধ। তাদের এ বিরোধে ঘি ঢালছেন দলের জেলা সভাপতি আর সাবেক এমপি লালু।
উপজেলা নির্বাচনে জেলা সভাপতির সুপারিশেই বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রথমে লালুবিরোধী উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামকে দলীয় সমর্থন দেয়া হয়। এরপর পরে মাঠ যাচাইয়ের পর সমর্থন ঘুরে যায় লালুর পক্ষের নেতা মোরশেদ মিল্টনের দিকে।