চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চতুর্থ ধাপের ২৬ জেলার ৬৮ উপজেলাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও সহিংসতাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া প্রতিবেদন ও সাম্প্রতিক সময়ের সহিংসতা বিবেচনায় এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এসব উপজেলায় সেনাসহ বাড়তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করবে কমিশন। ভোটের দিন এসব এলাকায় কমিশন থেকেও নজরদারি করা হবে বলে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আজ আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করার কথা জানিয়েছেন ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম।
ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে যে কোনো মূল্যে সহিংসতা, ভোট কেন্দ্র দখল ও ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই রোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কোনো ভোট কেন্দ্রে গোলযোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে সে কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করার নির্দেশনাও রিটার্নিং অফিসারকে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোথাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইসিকে অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গেই ভোট স্থগিত করতে বলা হয়েছে। গোলযোগপূর্ণ এলাকায় প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোবাইল টিম টহলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ধাপের নির্বাচনে সরকারি বা বিরোধী দল কোনো পক্ষকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে ইসি। বিশেষ করে নির্বাচনের দিন অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৬৬ উপজেলায় বাড়তি নজরদারি করবে কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৪৩ জেলার ৯৩ উপজেলার মধ্যে ২৩ মার্চ দেশের ৯১ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে। আদালতের নির্দেশে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও শেরপুর সদর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ৯১ উপজেলায় লড়াই করবেন ১ হাজার ২৭৭ জন প্রার্থী। প্রতি উপজেলায় গড়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন পাঁচজন। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৪৭ এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫১৯ জন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩১১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ধাপেও আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিদ্রোহীদের দাপট রয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ৩৭ ও বিএনপির ৩৩ উপজেলায় রয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী। এসব বিদ্রোহী প্রার্থীকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন কোনো না কোনো উপজেলায় ঘটছে সহিংসতার ঘটনা। ফলে নির্বাচন ঘিরে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। নিজ দলের প্রার্থী-সমর্থকদের মধ্যেই এ ঘটনা বেশি ঘটছে।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৬ জেলার ৬৮ উপজেলায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো রাজশাহীর তানোর, পুঠিয়া, বাগমারা; পাবনার ঈশ্বরদী ও ফরিদপুর; কুষ্টিয়ার দৌলতপুর; ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু; যশোর সদর ও কেশবপুর; বাগেরহাটের চিলমারী ও মোল্লারহাট; খুলনার ফুলতলা, তেরখাদা, রূপসা, বটিয়াঘাটা ও দাকোপ; সাতক্ষীরার কলারোয়া; বরগুনার বেতাগী; পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, মির্জাগঞ্জ, বাউফল ও দুমকী; ভোলার তজুমুদ্দিন, মনপুরা ও দৌলতপুর; বরিশালের আগৈলঝারা, উজিরপুর ও বানারীপাড়া; ঝালকাঠি সদর, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও নলছিটি; পিরোজপুর সদর, জিয়ানগর, ভা-ারিয়া ও মঠবাড়িয়া; টাঙ্গাইলের কালিহাতি, ভূয়াপুর; কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ইটনা, কটিয়াদি, মিঠামইন ও তাড়াইল; মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া; গাজীপুরের কালিয়াকৈর; সুনামগঞ্জের শাল্লা; মৌলভীবাজার সদর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল; হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, লাখাই ও নবীগঞ্জ; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও নাসিরনগর; কুমিল্লার মেঘনা ও বরুড়া; ফেনীর সোনাগাজী ও ফুলগাজী; নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, রাউজান, ফটিকছড়ি, রাংগুনিয়া, বোয়ালখালী ও সাতকানিয়া উপজেলা।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা সবসময় চাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। এজন্য যা যা করা দরকার আমরা তাই করছি। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে এবং নিরাপদে পেঁৗছতে পারে এজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবে। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য মুখের কথা যথেষ্ট নয়। তাই আমরা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করছি। ২৩ মার্চ নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে কমিশন। সহিংসতা রোধে সবের্ক্ষাচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যর্থ হলে নির্বাচন কমিশন নিজ উদ্যোগে সহিংসতাপূর্ণ এলাকার নির্বাচন বন্ধ করে দেবে বলেও জানান তিনি। উল্লেখ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বেশি জয়ী হয়েছেন। তৃতীয় ধাপে এগিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। ২৩ মার্চ চতুর্থ ধাপে ৯১ ও ৩১ মার্চ ৭৪টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
আতঙ্কে প্রার্থী ও ভোটাররা : আতঙ্ক আর চরম উত্তেজনার মধ্যে রোববার ৪৩ জেলার ৯১ উপজেলার ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন উপজেলায় সরকার সমর্থিত প্রার্থী ও সমর্থকদের হুমকি-ধমকিতে আতঙ্কে রয়েছে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী, এজেন্ট ও ভোটাররা। প্রকাশ্যে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার ঘোষণা ও হুমকি দেয়া হয়েছে অনেক স্থানে। কোথাও কোথাও প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমেও হয়রানি করা হচ্ছে বলে ইসিতে অভিযোগ এসেছে। কেন্দ্র দখল ও ভোট জালিয়াতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বেশিরভাগ আবেদনকারী। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন প্রার্থী ও ভোটাররা। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছে কমিশন।
রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৪৩ জেলার ৯১ উপজেলায় চলবে বিরতিহীন এ ভোটগ্রহণ। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ১৮৬ প্রার্থী। নির্বাচনী এলাকা এরই মধ্যে সেনা, বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা টহল শুরু করেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। এছাড়া নির্বাচনী মাঠে শক্ত অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। সব ধরনের প্রচারণা শেষে এখন শুধু ভোটগ্রহণ উপলক্ষে এসব এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে ইসি। এদিকে স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চতুর্থ ধাপের ৯১ উপজেলার মধ্যে ৩৭ উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। আর বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন ৩৩ উপজেলায়।
নির্বাচন প্রস্তুতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোঃ আবু হাফিজ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোয় নিরাপত্তা রক্ষী বাড়াতে সব সিদ্ধান্ত নেবে স্থানীয় প্রশাসন। পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়াতে বা কমাতে পারবে তারা। পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসি থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে সেসব ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, চতুর্থ ধাপের ৪৩ জেলার ৯৩ উপজেলার মধ্যে ২৩ মার্চ দেশের ৯১টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে। আদালতের নির্দেশে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও শেরপুর সদর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ৯১ উপজেলায় প্রার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১৮৬ জন। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৮৯ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৮৫ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩১২ জন প্রার্থী।
এসব উপজেলায় ভোটার ১ কোটি ৩৮ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬৯ লাখ ৭ হাজার ৯৫৬ ও মহিলা ভোটার ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ৩২২ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৮৪টি, ভোটকক্ষ ৩৯ হাজার ৫১৬টি। প্রিসাইডিং অফিসার প্রতি ভোট কেন্দ্রে একজন করে ৫ হাজার ৮৮৪ জন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার প্রতি ভোটকক্ষের জন্য একজন করে ৩৯ হাজার ৫১৬ জন এবং পোলিং অফিসার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৩২ জন দায়িত্ব পালন করবেন।
টহলে সেনা, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে ৯১ উপজেলায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে টহল শুরু করেছে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড। নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে মোট পাঁচ দিন তারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতি উপজেলায় এক প্লাটুন করে সেনাবাহিনীর সদস্য টহল দিচ্ছেন। বড় উপজেলায় এ সংখ্যা আরও বেশি। পাশাপাশি প্রতি উপজেলায় সেনাবাহিনীর দুই থেকে তিনটি গাড়ি টহলে রয়েছে। সঙ্গে সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ও একজন করে ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছেন। এছাড়া মোবাইল ফোর্স হিসেবে পর্যাপ্ত র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকছেন। এছাড়া প্রতি কেন্দ্রে একজন পুলিশ (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার একজন (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার ১০ জন (মহিলা-৪, পুরুষ-৬) এবং আনসার একজন (লাঠিসহ) ও গ্রামপুলিশ একজন করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন। ঝুঁকিপূর্ণ, পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও হাওর এলাকায় এ সংখ্যা শুধু পুলিশের ক্ষেত্রে দুজন হবে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৩৬৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ৯১ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১২ ফেব্রুয়ারি ৯২ উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। এর সপ্তাহখানেক পর ভোটের দিন ঠিক রেখে ঢাকার ধামরাই উপজেলারও তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপের, ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের ও ১৫ মার্চ তৃতীয় ধাপের ভোট হয়। রোববারের পর ৩১ মার্চ পঞ্চম ধাপের ৭৪ উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।