একটি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ ৪র্থ উপজেলা নির্বাচন নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সহ আমাদের গোটা রাজনৈতিক কাঠামো কে । লোকবলের স্বল্পতার অজুহাতে ৫ধাপে মাসব্যাপি এইনির্বাচন অনুষ্ঠান অনেকক্ষেত্রেই পেশ শক্তির ব্যবহার এবং স্বন্ত্রাসী কার্যকলাপ কে উৎসাহিত করেছে তা বলা যায়। ভবষ্যতোতীয় নির্বাচনের আদলে একই দিনে উপজেলা নির্বাচন করাটাই সমিচীন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। একেকটি ধাপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার সর্ব শক্তি নিয়োগ করেছে পরবর্তি ধাপগুলোতে,ফলশ্রুতিতে বহু আসনে নির্বাচন হয়েছে রক্তাক্তএবং প্রশ্নবিদ্ধ।
আইনের বাধ্যবাধকতা গ্রাহ্য না করে দল দুটি নির্দলীয় নির্বাচনে সরাসরি প্রার্থী মনোনয়ন দিতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতির। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে মনোনীত প্রার্থীকে মেনে নেয়নি তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। কেন্দ্রের মনোনীত প্রার্থীকে ঠেকাতে তারা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী। আবার অনেক উপজেলায় তৃণমূল নেতারা 'বিদ্রোহী প্রার্থী' দাঁড় করানোর ঝুঁকি না নিয়ে নেপথ্যে সমর্থন জুগিয়েছেন ভিন্ন দলের প্রার্থীকে। কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ তুলে বিদ্রোহ করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের তৃণমূল নেতাদেরই। প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কেন্দ্র থেকে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও হয়েছেন বিভক্ত। দুই দলের তৃণমূলই জড়িয়েছে অন্তর্কোন্দলে। নির্বাচনের সময় এ কোন্দল রূপ নিয়েছে সহিংসতায়। সব মিলিয়ে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির তৃণমূল ছিল হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণহীন।
উপজেলা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলেও সত্যতা মিলছে ওই তথ্যের। দেখা গেছে, বিএনপি অধ্যুষিত জেলাগুলোতে ভালো ফল করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। একই ভাবে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত জেলাগুলোতে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী। আবার কোনো কোনো এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্র সমর্থিত প্রার্থীকে হারাতে জামায়াত প্রার্থীর পক্ষেও নেমে গেছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক নেতা। বিএনপির কেন্দ্র নির্ধারিত প্রার্থীর পরাজয় ত্বরান্বিত করতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ব্যালটে পড়েছে বিএনপির ভোট।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের ঘায়েল করার এ খেলায় অনেক উপজেলায়ই অপ্রত্যাশিত ভালো ফল করেছে রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকা জামায়াত। চতুর্থ দফা নির্বাচন শেষে দেখা গেছে, প্রথম দুই দফায় এগিয়ে থাকলেও শেষ দুই ধাপে বিএনপিকে ডিঙিয়ে স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে ৯টি ভোট কেন্দ্রে। ঠিক একই রকম সহিংসতার ঘটনা ঘটে ফেনী, কুমিল্লা, বরিশালসহ কয়েকটি জেলায়। এসব ঘটনায় নির্বাচন স্থগিত করে ইসি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ধাপে ধাপে নির্বাচন হওয়ায় ফল পক্ষে নিতে রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থিত বা বিদ্রোহী প্রার্থীরা অতিমাত্রায় সহিংস আচরণ করছে। এ কারণে প্রথম দুই ধাপের তুলনায় শেষ দুই ধাপের নির্বাচনে সংঘর্ষ, সহিংসতা, গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে নির্বাচনের মান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন দলীয় ব্যানারে না হলেও সব এলাকাতেই দলীয় প্রভাব রয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত না এলেও উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশ নেয়ায় নির্বাচনটি অনেকটাই উৎসবমুখর হচ্ছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল পছন্দমতো প্রার্থী দিয়েছে। একই সঙ্গে বড় দুটি দলের অসংখ্য বিদ্রোহী প্রার্থীও ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এ কারণে নির্বাচন ঘিরে প্রার্থীদের মধ্যে ছিল টান টান উত্তেজনা। সঙ্গত কারণে অনেক এলাকায়ই উত্তেজনা সহিংসতায় গড়ায়। সহিংসতা কেবল আওয়ামী লীগ-বিএনপি, আওয়ামী লীগ-জামায়াত প্রার্থীদের মধ্যেই ঘটেনি_ অনেক স্থানেই সহিংসতা হয়েছে বিএনপি বনাম বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে, আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যেও। কোথাও কোথাও বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে সহিংসতায় জড়িয়েছে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীও। উপজেলা নির্বাচনে ১৯ দলীয় জোটের একক প্রার্থী দেয়ার জটিলতা বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, মাঠের দৃশ্য বিএনপির পক্ষে থাকলেও ফসল ততোটা গোলায় আসছে না। জামায়াতের কারণে ১৯ দলীয় জোটের 'স্পিরিট' ও সমর্থন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিএনপির প্রার্থীকে জামায়াত সমর্থন না দিয়ে তারাও প্রার্থী দিয়েছে। এতে তাদের সম্পর্কে অন্য রকম ধারণা হতেই পারে। তবে তিনি বলেন, সরকারের মারমুখী অবস্থানও নির্বাচনের ফল বিএনপির পক্ষে আসাটা বাধাগ্রস্ত করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের এক নেতা বলেন, জামায়াতের জনসমর্থন বেড়ে যাওয়ায় এবার বেশিসংখ্যক প্রার্থী দেয়া হয়েছে।
প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী দেয়ার সময় থেকেই মূলত বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন দেখা দেয়। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দফার নির্বাচনেও তা বহাল থাকে। এ নিয়ে বিএনপির অভিযোগ, জামায়াত প্রার্থী না দিলে তাদের অনেক প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসত। একই ভাবে জামায়াতের দাবি, বিএনপি প্রার্থী না দিলে তাদের আরও বেশি সংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসত।
রহস্য জনক ভাবে এই গূরুত্বপূর্ন ও দূরুহ নির্বাচনের প্রারম্ভে প্রধ নির্বাচন কমিশনর রকীবউদ্দিনের ছুটিতে বিদেশ গমন কারও বোধগম্য হয়নি।দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম-সহিংসতা হওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করতে হয়। যদিও আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর গিলতে দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন সুষ্ঠু দাবি করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেছেন, মানুষ মারা যেতেই পারে, তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে সাড়ে পাঁচ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৩২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করতে হয়েছে। এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলা যায়।
তবে কমিশনের এ মতের বিরোধিতা করে বিএনপি বলছে, উপজেলা নির্বাচন মোটেও সুষ্ঠু হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভোট কেন্দ্র দখলের মহোৎসব চালাচ্ছে। দেদার জাল ভোট দেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রশাসন পালন করেছে নির্বিকার ভূমিকা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলে অনেক ক্ষেত্রেই এ অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা এড়ানো সম্ভব ছিল। দাখিল হওয়া অভিযোগগুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন এলাকাভেদে আলাদা আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে অনেকাংশেই সহিংসতা কম হতো। সহিংসতা রোধে যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ার ব্যর্থতা সম্পূর্ণভাবে ইসির। উপজেলা নির্বাচনে মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে তারা অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায়। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যত হৈচৈ হচ্ছে, এর আগে তেমনটি দেখা যায়নি। এরশাদের আমলে দুইবার উপজেলা নির্বাচন হলেও ওই নির্বাচন নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করে উপজেলা নির্বাচন দেন শেখ হাসিনার সরকার। তখনও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তেমন হৈচৈ হয়নি। তবে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বহীন বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনটিকে দলীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্ব দেয়ায় ব্যতিক্রম দেখা গেল। গণমাধ্যম নির্দলীয় নির্বাচনের ফল দেখানো শুরু করার কারণেও ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচন যত এগিয়েছে, তত উত্তেজনা বেড়েছে নির্বাচন ঘিরে। প্রথম বা দ্বিতীয় দফায় পিছিয়ে থাকা দল ফল নিজেদের পক্ষে আনতে বেপরোয়া হয়েছে। এতে বেড়েছে সহিংসতা। উল্লেখ্য, চার ধাপের নির্বাচনের ফলে দেখা যায়, চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয় পেয়েছেন ১৭০ উপজেলায়, বিএনপি ১৪০টিতে আর জামায়াতের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৩৩টি উপজেলায়। রোববার অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে দেখা গেছে, বিএনপি অধ্যুষিত ফেনীর ফুলগাজী ও সোনাগাজী দুই উপজেলায়ই জিতেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী, আবার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় বিএনপির শক্তিশালী কোনো প্রার্থীই ছিল না। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীসংখ্যা ছিল পাঁচজন। আবার ২০ উপজেলায় বিএনপি জামায়াতের পাশাপাশি প্রার্থী ছিল। হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণহীন এসব প্রার্থীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কোন্দল, সহিংসতা যেমন বেড়েছে; পাল্টেও গেছে তেমনি হিসাব-নিকাশ।