মিসরের এক আদালত ক্ষমতাচ্যুত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ৫২৯ জন সমর্থককে এক যোগে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্যকে হত্যা, জনসাধারণের উপর হামলা এবং তাদের সম্পত্তি ধ্বংসসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আধুনিক মিসরের ইতিহাসে এটা বৃহত্তম 'গণ মৃত্যুদন্ড' দেয়ার ঘটনা। এই বিচার প্রক্রিয়ায় মিসরের প্রধান ইসলামপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাসহ ১২শ' জন মোরসি সমর্থক সম্পৃক্ত ছিল।
গত বছর জুলাই মাসে মোহাম্মদ মুরসি সেনাবাহিনী দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হবার পর মিসরের কর্তৃপক্ষ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর দমন অভিযান চালিয়েছে। এতে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন হাজার হাজার। মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষস্থানীয় নেতা মোহাম্মদ বাদিকেও আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছে। খবর বিবিসি ও রয়টার্সের।
সূত্র জানায়, আদালতের রায় এখন মিসরের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা, গ্র্যান্ড মুফতির কাছে পাঠানো হবে। তিনি সেটা অনুমোদন কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। বিচার প্রক্রিয়া ২৮শে এপ্রিলের আগে শেষ হবে না। কাজেই মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আগে বেশ কিছু সময় আছে এবং তার মধ্যে আপিল করার সুযোগ থাকবে।
লন্ডনে মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখপাত্র আব্দুল্লাহ আল-হাদ্দাদ বিবিসিকে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এটা শুধুমাত্র একটি হুমকি হতে পারে। আদালতে আপীল হবে এবং এই রায়ের পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু এই সাজা প্রমাণ করে মিসর এখন একটি স্বৈরতন্ত্র। তিনি আরো বলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের পর এটাই হলো নতুন মিসর। নতুন মাত্রার স্বৈরতন্ত্র। সেনাপ্রধান আব্দুল্লাহ আল-সিসি এই নতুন স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন।
মাত্র দুটি শুনানিতে রায়:কায়রোর দক্ষিণে অবস্থিত মিনায়া শহরে আদালত মাত্র দু'টি অধিবেশনের পরই তাদের রায় ঘোষণা করে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগের একটি ছিল মিনায়ার মাতায় থানার সহকারী পুলিশ প্রধানকে হত্যা। আসামী পক্ষের উকিলরা অভিযোগ করেন যে, তাদের মক্কেলদের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরার কোন সুযোগ তারা পান নি। আইনজীবীরা প্রধান বিচারকের বিরুদ্ধে 'আইনের পথ থেকে বিচ্যুত' হবার অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, আসামীদের ন্যায় বিচার দেওয়া হয়নি।
সবাই গ্রেফতার হয়নি : যাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সবাইকে গ্রেফতার করতে পারেনি মিসর প্রশাসন। অভিযুক্তদের মধ্যে দেড়শ' জনের বেশি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাকিদের বিচার তাদের অনুপস্থিতিতেই সম্পন্ন করা হয়। রায় ঘোষনা উপলক্ষ্যে অভিযুক্তদের স্বজনরা আদালতের বাইরে ভীড় করেন। মৃত্যুদন্ডের রায় শুনে তারা হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করেন। তাদের কান্নার শব্দে আদালত পাড়ার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। আজ মঙ্গলবার আরো ৭০০জন মুরসি সমর্থকের বিচার শুরু হবে।
গত বছর আগস্ট মাসে মিসরের রাজধানী কায়রোতে মুরসির সমর্থকদের দুটো জনসভা নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভেঙ্গে দেয়। মুসলিম ব্রাদারহুডকে পরবর্তীতে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়, এবং তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
দ্রুততম বিচার : মিসরের প্রখ্যাত আইনজীবী নাবিল আবদেল সালাম এই বিচারকে 'দ্রুততম বিচার' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, আইন বিভাগে অধ্যায়নরত দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্রও এমন রায় ঘোষণা করবে না। এই মামলায় এত খুঁত আছে যে তা গুনে বের করা কঠিন। আপীলে আসামিরা খালাস পেয়ে যাবেন বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি। তবে এটাও বলেন, খালাস না পেলেও অবাক হব না।
মানবাধিকার সংগঠনের নিন্দা : এদিকে, মিসরের আদালতে ব্রাদারহুডের কর্মী সমর্থকদের এই গণ মৃত্যুদন্ডের নিন্দা জানিয়েছে সেদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। তারা বলেছে, এটা যে ন্যায়বিচার নয় তা বুঝতে কারো খুব কষ্ট হবার কথা নয়। সেনাবাহিনী মিসরে তার ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করতে বিরোধী মত ধ্বংস করে দিতে এই বিচারের আয়োজন করেছে বলে তাদের অভিযোগ।
ব্রাদারহুডের ক্ষমতারোহন: মুসলিম ব্রাদারহুড মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বৃহত্ ইসলামপন্থী সংগঠন। ১৯২৮ সালে মিসরে হাসানুল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। মিসরের ৮৫ বছরের পুরোনো ইসলামী দলটিকে ১৯৫৪ সালে নিষিদ্ধ করেছিলো তত্কালীন সেনা শাসকেরা। পরবর্তীতে এটি মুসলিম ব্রাদারহুড অ্যাসোসিয়েশন নাম নিয়ে একটি এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত হয়। পরে ব্রাদারহুডের 'ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি)' নামে বৈধ নিবন্ধিত রাজনৈতিক শাখা করা হয়। স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে গণ-অভ্যুত্থান শুরুর পর এ শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উপর ভর করে ২০১২ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছিলো ব্রাদারহুড। মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি। গত বছরের ৩ জুলাই সেনা হস্তক্ষেপে তার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।
সেনা নিপীড়ন: মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির পরই ব্রাদারহুডের দুঃস্বপ্নের দিন শুরু হয়। দলটির নেতা-কর্মীদের উপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর মুসলিম ব্রাদারহুডের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে দলটির সকল সম্পত্তিও বাজেয়াপ্তের নিদেশ দেয় আদালত। আর সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
মিসরে 'সেনা ফ্যাক্টর' : ইতিহাস বলে, মিসরে সেনাবাহিনী একটি শক্তি। ৬১ বছর ধরেই তারা ক্ষমতায়। মাঝখানে সীমিত পরিসরে ২০১১ সালের বিপ্লবের পর কিছুদিন পর্যন্ত তারা পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। এখন আবার তারা প্রকাশ্যে। ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্র উত্খাতের মধ্য দিয়ে মিসরের সেনাবাহিনী সেখানে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কর্নেল জামাল আবদুল নাসের ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শুধু মিসরেই নয়, বরং সমগ্র আরব বিশ্বে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিলেন। পুরো আরব বিশ্ব এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বে এক অবিসংবাদিত নেতায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর সেই আদর্শকে সামনে রেখেই আনোয়ার সাদাত আর হোসনি মুবারক রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন। তবে পশ্চিমা বিশ্বের চাওয়া অনুযায়ী মোবারকের পতন হয়। মাঝখানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য মুরসি এসেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর এই শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেননি। যার ফলেই তার পতন হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন।