DMCA.com Protection Status
title="৭

রক্তের অর্জন সহিংসতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পেশী শক্তিতে বিসর্জন। কাঠগড়ায় নির্বাচন কমিশন : বিশিষ্টজনদের অভিমত

1_63391দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ  দেশের প্রথম উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে এরশাদের সামরিক শাসনামলে।। এরপর দ্বিতীয় নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। এসব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার দাবিতে কম রক্ত ঝরেনি। রাজপথে প্রাণ দিয়েছেন অনেকেই। কেন্দ্র দখলই ছিল তখনকার নির্বাচনী রেওয়াজ। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে এ নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসে। এরপরও ১৯৯৫ সালের মাগুরা উপনির্বাচন দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কলঙ্ক তিলক হয়ে আছে। ২০০৭ সালে সাবেক সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বাচনে ব্যাপক সংস্কার আনা হয়। পুরোপুরি পাল্টে যায় নির্বাচনী সংস্কৃতি। আতঙ্কের ভোট পরিণত হয় উৎসবে। মা তার ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছেন- এ দৃশ্য দেখা গেছে অহরহ। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনও সব মহলের গ্রহণযোগ্যতা পায়। 

 

এই প্রথম ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন। মঙ্গলবার শেষ হয়েছে পঞ্চম ধাপের ভোট। এবার ধাপ যত বেড়েছে ততই বেড়েছে অনিয়ম, সন্ত্রাস। বেশকিছু এলাকায় প্রকাশ্যে কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপজেলা নির্বাচন দেশে গত কয়েক বছরের সৃষ্ট নির্বাচনী সংস্কৃতিকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এ নির্বাচন মানুষের আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে, যা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলে দাবি করেছেন এসব বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ নির্বাচন গণতন্ত্র এবং দেশের জন্য কখনোই শুভ হবে না। তাদের মতে, রক্তঝরা অর্জন সহিংসতায় বিসর্জন হয়েছে। 

 

বড় ক্ষতি হয়ে গেল : সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব দিয়েছে। যারা রক্ষাকর্তা তারা যদি নির্বাচনটা রক্ষা করতে না পারেন তাহলে সবকিছু এভাবেই শেষ হয়ে যাবে। নির্বাচনের সঙ্গে সরকার, রাজনৈতিক দল, জনগণ, অনেক স্টেকহোল্ডার জড়িত। কিন্তু আমরা উপজেলা নির্বাচনে দেখলাম সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার যার ইচ্ছেমতো সে সে কাজ করেছেন। কিন্তু কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এ নির্বাচনে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। একবার মানুষের আস্থা চলে গেলে তা ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন। আমরা আবার অনেক পিছিয়ে গেলাম। যে নির্বাচনী সংস্কৃতি আগের কমিশন চালু করে দিয়ে এসেছিল উপজেলা নির্বাচনে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভোটে আবার লুটপাটের সংস্কৃতি চালু হলো, যা গণতন্ত্র এবং দেশের জন্য কখনোই শুভ নয়। দেশ, রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য বড় ক্ষতি হয়ে গেল। 

 

কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না : সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মঙ্গলবার এক নির্বাচন কমিশনারের কথা শুনে মনে হয়েছে এ নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন অনেক জায়গায় ইসির কথা শোনেনি। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপরও কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনের পর তা অনুধাবন না করে প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর তা করলে ভালো হতো। শক্ত হাতে প্রথমদিকে নির্বাচনে অনিয়ম, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ধাপে ধাপে তা বাড়ত না। কমিশনের ঢিলেমি দেখে ধাপে ধাপে প্রার্থীরা অনিয়মে উৎসাহিত হয়েছেন। এ নির্বাচন গত কয়েক বছরে মানুষের যে আস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে সরাসরি আঘাত করেছে। সামনে ইউনিয়ন পরিষদের মতো জটিল নির্বাচন আছে। এসব নির্বাচনে কী হবে তা আল্লাহ মালুম। সংবিধান যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব কমিশনকে দিয়েছে, সেহেতু সব দায়দায়িত্ব কমিশনের ওপর বর্তাবে এটাই স্বাভাবিক। ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া যায় জাতির জন্য ততই মঙ্গল। 

 

মানদ- ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ’৮৬, ’৮৮ ও ’৯৫ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের দীর্ঘদিন পর সুষ্ঠু নির্বাচনের যে মানদ- আমরা অর্জন করেছিলাম, সেটা আবারও ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আমরা যে আশঙ্কার কথা বলে আসছিলাম তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ৩১ মার্চ পঞ্চম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে। এ নির্বাচন একটি বিতর্কিত নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, সোমবারের নির্বাচন শুধু বিতর্কিতই নয়, এতে নির্বাচন কমিশন- যাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা, সেই প্রতিষ্ঠানও বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। এ নির্বাচনে যেভাবে ভোট ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটেছে, তাতে নির্বাচন কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার কারণে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া ঝুঁকির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন ড. বদিউল আলম মজুমদার। এটা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

 

পেছনে যাত্রা শুরু : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা আবার নির্বাচনী সংস্কৃতির পেছনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আশির দশকে যে ধরনের নির্বাচন হতো ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে নির্বাচন প্রক্রিয়া। উপজেলা নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাইসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। তবে এ বিতর্কের এখনও সংশোধন করার সুযোগ আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সব জায়গার নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হয়নি। কিছু জায়গায় সহিংস কর্মকান্ড হয়েছে। সবমিলিয়ে এর পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি হবে না। বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য আছে। নির্বাচন কমিশন যদি এসব খবরের সূত্র ধরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ফের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে তাহলে তা শুদ্ধ হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনও তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

দেশ ও জাতি অনেক পিছিয়ে গেছে : জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, উপজেলা নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার বড় প্রমাণ হচ্ছে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনিয়ম। এ নির্বাচনের কারণে দেশ ও জাতি অনেক পিছিয়ে গেছে। আমরা আবার সেই ’৮৬, ’৮৮ ও ’৯৫-এ ফিরে গেছি। নির্বাচনে ভয়াবহ অবনতি হয়েছে আমাদের গনতান্ত্রীক মূল্যবোধের। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!