DMCA.com Protection Status
title="৭

“উনিশ শ একাত্তর”,মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারনমূলক প্রামান্য ধারাবাহিকঃসাইদুল ইসলাম,পর্ব-২

10167945_10203543240170746_843595010_aউনিশ শ’ একাত্তর: সাইদুল ইসলাম

পর্ব-২ 

 

২০ বেলুচের অফিস মাত্র মিনিট কয়েকের পথ। মজুমদারের মেজাজ খাট্টা হয়ে গিয়েছিলো। গন্তব্যে পৌছেই তিনি জেনারেলদের জিজ্ঞাসা করবেন তাকে এভাবে এড়িয়ে যাবার কারণ। আর কাউকে না হোক ব্রিগেডিয়ার আনসারিকে তিনি ধরতেই পারেন। চাকরিতে খুব বেশি সিনিয়র তিনি নন। জেনারেলদের বহর থেকে তিনি একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন। গাড়ি থেকে নামতে নামতে তাঁদের ফাতিমীর অফিসে ঢুকতে দেখে প্রায় দৌড়ে তিনিও ফাতিমীর অফিসে ঢুকতে যাচছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে টি বারে বসলেন এজি (এডজুট্যান্ট জেনারেল)। মজুমদারের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখে তাঁর ঠোঁটের কোনে হাসি ফূটে উঠলো, বললেন, ‘Come on Majumdar, I have some thing important to tell you, Chief will Join us later’.

তাঁর কথা শুনে শংকিত হয়ে পড়লেন মজুমদার। জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের শেষ কথাগুলি মনে পড়ে গেল তাঁর। ৬ তারিখে শেষ বার ফোন করেছিলেন ইয়াকুব খান। মাত্র কয়েকবার দেখা হলেও মজুমদারকে পছন্দ করতেন তিনি। ওয়্যারলেস কলোনীতে ফাতেমীর হঠকারিতায় হতাশ হয়ে তিনি নিজেই আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুর রহমান 1483370_646226165414263_1757529799_sমজুমদারকে। ব্যাপারটা অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা ভালো চোখে দেখেনি। দায়িত্ব দেবার দিন ইয়াকুবকে যতটা প্রত্যয়ী মনে হয়্রছিলো, ৬ তারিখে ততটাই নিষ্প্রভ মনে হয়েছে। শেষের দিকে একটু আবেগাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘তুমি মনে হয়তো জানো, আমি রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়েছি। দে হ্যাভ কল্ডমি ব্যাক টু জি এইচ কিউ। হুঁশিয়ার রাহেনা বেটা, তোমাকে আল্লাহ’র হাতে ছেড়ে যাচ্ছি’। 

মার্চের প্রথম ক’দিনেই বড় দু’টি পরিবর্তন হয়েছে কমান্ডে। এডমিরাল আহসানের জায়গায় গভর্নর হিসাবে এসেছেন বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত টিক্কা খান । ইয়াহিয়া খানের সাথে মতানৈক্যের কারণে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন সাহেব্জাদা ইয়াকুব খান। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লা খান নিয়াজী। এরা কেউই ইয়াকুবের মত নন। এরা হয় বাঙালিদের ভয় পান নাহলে ঘৃণা করেন। মজুমদারের মনে নানান দুশ্চিন্তা উঁকি দিতে থাকলো। 

তাঁর সাথে আওয়ামী লীগ নেতদের গোপন মিটিং এর খবরটা কী লিক হয়ে গেছে? ষাটের দশকে তিনি গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার কারণেই তিনি মিটিং এর ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন। মজুমদার জানতেন তাঁর পেছনেও টিকটিকি লাগানো আছে। তাই নেতরা যখন তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলেন তিনি ঠিক করলেন সেনানিবাসের বদলে যদি গভীর রাতে সার্কিট হাউসে মিটিংটা করা যায়, সেটা তেমন নজরে পড়বেনা। কারণ যেডএমএলে হিসাবে নতুন দায়িত্ব পাবার পর এমনিতেই তাঁকে অনেক রাত অব্ধি সার্কিট হাউসে থাকতে হয়। 

এম আর সিদ্দিকীর সাথে আগেই পরিচয় ছিলো তাঁর। ৫ তারিখ পরিচয় হলো ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর খন্দোকার মুশতাক আহমেদের সাথে। খন্দোকার সাহেব এসেছিলেন কুমিল্লা থেকে। প্রথমেই বললেন, ব্রিগেডিয়ার সাহেব আমার দাউদকান্দির পেট্রোল পাম্পটা আর্মির রিকুইজিসনে আছে, এইটা ছাড়িয়ে দিতে হবে। একটু অবাকই হয়েছিলেন মজুমদার, শেখ সাহেবের প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে এত রাতে কথা বলতে আসবেন এটা তিনি ভাবেন নি। অবশ্য ক্রমেই আলোচনা সিরিয়াস দিকে মোড় নিয়েছিলো। মনসুর আলী বলেছিলেন মুজিব ভাই জানতে চেয়েছেন মজুমদার কোন দলে? তিনি বললেন, ‘সরকারের দলে’। এ কথা শুনে নেতরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচায়ি ক্করতে থাকলেন। মুশতাক বললেন তাহলে আর বসে লাভ কি? মজুমদার তখন হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রেসিডেন্টতো বলেই দিয়েছেন ইলেকশনে বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। তাহলে শেখ সাহেবই তো সরকার গঠণ করবেন। এখন ভেবে বলেন তো আমার সাথে বসা ঠিক হবে কী না’।
আরও অনেক কথা বর্তার পর তিনি বলেছিলেন, শেখ সাহেবের প্রতি আমার দু’টি অনুরোধ, প্রথমটি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমা সৈন্য বাড়ানোর জন্যে এখন অপারেশন ব্লিতজ নামে গোপন একটা অপারেশন চলছে, ক’দিন পর শুরু হবে ‘গ্রেট ফ্লাই ইন’ । যে কোন উপায়ে এই অপারেশন বন্ধ করতে হবে, আইদার পলিটিক্যালি অর বাই ডেমন্সট্রেশন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আন্দোলন চট্টগ্রামমুখী করে ফেলা। উনি যদি একবার চট্টগ্রামে চলে আসেন, শুভপুর দখলে নিয়ে আমরা সারা দেশকে চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবো। ইপিআর, পুলিশ সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে আমরা পাকিস্তানীদের মাথা তুলতে দেবো না। চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সরকারের টনক নড়বে’। 

পরে কর্নেল ওসমানীর সাথেও এব্যাপারে কথা হয়েছে। ওসমানী আওয়ামীলীগের টিকেটে সিলেট থেকে নির্বাচনে জিতেছেন। শেখ সাহেবের সাথে তাঁর ভালো জানাশোনা। তবে মজুমদারকে এখনও তিনি ক্লিয়ারেন্স দেননি। আরও অনেক কিছু মজুমদারের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। 

এজি বললেন তোমাকে খুব চিন্তিত লাগছে মাহামুদ, এনিথিং রং? এই কথার উত্তর দিতে গিয়ে মৃদু হাসলেন মজুমদার ইউ নো স্যার, সিচুয়েশন ইন চিটাগং…..
– That’s what been Chief interested to know, How about Swat? 
– Swat is still in the port, loaded.
– এখনও খালি করাও নাই কেন?’ 
এই প্রশ্নটি মজুমাদারের কাছে খুব একটা অভাবিত নয়। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ৭০০০ টন গোলা বারুদ নিয়ে করাচী থেকে সোয়াত কোম্পানির একটি জাহাজ বন্দরে পৌচেছে। একুশ দিন তিনি নানান অজুহাতে এই জাহাজের আনলোড ঠেকিয়ে রেখেছেন। সোয়াত খালাস হলে শ্রমিক লীগ বন্দর অচল করার হুমকি দিয়েছে। তিনি বললেন, ‘বন্দরে ধর্মঘট চলছে, এখন তো জাহাজ আনলোড করা সম্ভব হবেনা’। এর আগে নতুন গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান আর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল এ ও মিঠার সাথে অনেক বার কথা হয়েছে তাঁর। শ্রমিক ধর্মঘটের কথা শুনে তাঁরা বলেছেন, ‘ইউ হ্যাভ ট্রুপস, টাস্ক দেম টু ডু ইট’। মজুমদার ধৈর্য হরাননি ‘বলেছেন দ্যাট উইল বি রিস্কি স্যার, দেয়ার আর এক্সপ্লোসিভস, মাই ট্রুপস আর নট ট্রেইন্ড। আনাড়ির মত কাজ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গোলাবারুদে আগুন না ধরে যায়’! এই কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে মিঠা বলেছেন, “If the fire engulfs the entire country and blood fills the Karnaphuli River, I don’t care. I want my arms unloaded.” পরে চট্টগ্রাম নেভীকে দিয়েও জাহাজ খালি করার চেষ্টা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম নেভির কমান্ডার কমোডোড় মুমতাজ বাংগালিদের ফূঁসে ওঠা নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি জেনারেলদেরও চটাতেও চাইছিলেন না বলেছেন করাচী থেকে কয়েকজন ট্রেইনড লোক আনা গেলে, কাজটা করতে সুবিধা হত’। 

গোলাবারুদ, এজির এক্তিয়ারে নয়। তবুও এ বিষয়ে তাঁকে কথা বলতে দেখে মজুমদার বুঝলেন আসলে হামিদের দিক থেকে তাঁর নজর ঘুরাতে চাইছেন এজি। প্রায় আধা ঘন্টা পর বের হলেন চীফ। তেমন কিছু না বলেই, নেভাল বেসে রওনা দিলেন। সেখানেও মজুমদারকে মূল আলোচনার বাইরেই থাকতে হলো। দুপুরে সিও , ওসিদের ( বড় ইউনিটের অধিনায়কদের সিও আর ছোট ইউনিটের অধিনায়কদের বলা হয় ওসি) সাথে লাঞ্চ সেরে ঢাকার পথ ধরলেন সেনা প্রধান।

সেদিন বিকেলেই এম আর সিদ্দিকীকে ডেকে পাঠালেন মজুমদার, বললেন ‘সব কিছু আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবার আগেই কিছু করতে হবে। আপনি আজই ঢাকায় গিয়ে শেখ সাহেবের সাথে দেখা করেন, আমি এর আগে দুইবার ওনার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। কোন সাড়া পাইনি। খুব শীগগিরই ওরা ভয়ংকর কিছু করতে চাইছে। তাঁর আগেই আমাদের পাল্টা ব্যাবস্থা নিতে হবে। ডিআইজির সাথে কথা বলে একটা পুলিশের গাড়ি যোগাড় করা হল, পথে যেন তিনি তল্লাসী এড়াতে পারেন। 

সন্ধ্যার সময় মেজর জিয়া বঊ নিয়ে বেড়াতে এলো। জিয়া যখন এফ আই ইউতে চাকরি করতো তখন থেকেই তাঁর সাথে পরিচয়। ছেলেটাকে তিনি বেশ পছন্দ করেন। স্বামীর উপর সারাদিন যে ধকল গিয়েছে, সেটা জিয়ার সাথে শেয়ার করে একটু হালকা হবেন ভেবেই মজুমদার গিন্নি জিয়ার মিসেসকে আজ ভিতরে ডেকে নিলেন। অণ্যান্য কথাবার্তার ফাঁকে জিয়া হঠাত বললেন, ‘স্যার সিচুয়েশন কেমন বুঝছেন?’ মজুমদার জিয়াকে বিশ্বাস করবেন কী করবেন না বুঝতে পারছিলেন না। ছেলেটার ক্যারিয়ার ভালো। পিএমএর প্লাটুন কমান্ডার ছিলো। এবারের বোর্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেলও হয়ে যাবার কথা। যদিও এম আর চৌধুরি তাঁকে বলেছেন জিয়া তাদের সাথে আছে, তারপরও জিয়ার ইন্টেলিজেন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা চিন্তা করে তিনি শুধু বললেন কিপ আই অন ইউর সিও। 

সূত্রঃ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, সামরিক জীবনের স্মৃতি, একাত্তরের বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র ৯ম খন্ড, Witness to Surrender, Bangladesh at War, The way it was, মুক্তি যুদ্ধে নয় মাস। ১৯৯৯ সালে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সাথে মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া ও আমার আলাপচারিতা।

 

ক্রমশ……

 

 

 

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!