দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ: সারাদেশে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে ২০১৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা। এবার নিবন্ধন করেও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না দুই লাখ নয় হাজার ৯১৩ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে আটটি সাধারণ বোর্ডে এক লাখ ৬৯ হাজার ১৩৬, কারিগরি বোর্ডে নয় হাজার ৯৯৪, মাদ্রাসা বোর্ডে ৩০ হাজার ১৫৩ এবং ডিআইবিএসে ৬৩০ জন পরীক্ষার্থী রয়েছে।
অথচ ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে সবকটি বোর্ডের অধীনে একাদশ শ্রেণিতে মোট ১১ লাখ ২৬ হাজার ৪৮১ জন পরীক্ষার্থী নিবন্ধন করেছিল। এর বিপরীতে নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে মোট ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৪ পরীক্ষার্থী চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা অংশ নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা বলেছেন, দুই লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয় নি। এরমধ্যে কিছু অংশ ঝড়ে পড়েছে, কিছু অংশ নানা জটিলতায় পরীক্ষা দিচ্ছে না। তবে কেন বিপুল পরিমাণ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়নি তার কারণ খুঁজে বের করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পরীক্ষায় অংশ না নিলেই যে ঝরে পড়েছে এটি বলা যাবে না। বিভিন্ন কারণে একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে নাও পারে। তবে ঝরে পড়ার হার অনেক কমেছে। আর দুনিয়ার কোনো দেশেই ঝরে পড়া বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, দারিদ্যের কারণে অনেকেই এসএসসি ও এইচএসসিতে ঝরে পড়ে। কোনো না কোনো ভাবে চেষ্টা করব যাতে তারা শিক্ষায় টিকে থাকে। এজন্য প্রয়োজন ‘বেসিক এডুকেশন’। এটি করতে পারলে কোনো সমস্যা নেই।
পরীক্ষার্থী বেড়েছে এক লাখ ২৮ হাজার : উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা উপলক্ষে বুধবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর এক লাখ ২৮ হাজার ৭৯৩ জন পরীক্ষার্থী বেড়েছে। গত বছর মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লাখ ১২ হাজার ৫৮১ জন। এবার অংশ নিচ্ছে ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৪ জন। অংশ নেয়া মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ৬ লাখ ৬ হাজার ২৯৩ জন ও ছাত্রী ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮১ জন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, এবার মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসিতে (উচ্চ মাধ্যমিক) নয় লাখ ২৪ হাজার ১৭১, মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে আলিমে এক লাখ ৭ হাজার ৫৫৭, কারিগরি বোর্ডের অধীনে এক লাখ ৪ হাজার ৬৬৯ ও ডিআইবিএসে চার হাজার ৯৭৭ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। মন্ত্রী জানান, লিখিত পরীক্ষা শেষ হবে ৫ জুন। ব্যবহারিক পরীক্ষা ৭ জুন শুরু হয়ে শেষ হবে ১৬ জুন।
এবার আট হাজার ১০৪টি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা দুই হাজার ৩৫২টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে। বিদেশে পাঁচটি কেন্দ্রে ২০২ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে ৯১ জন ছাত্র এবং ১১১ জন ছাত্রী।
বোর্ড ওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে তিন লাখ ৩৮, রাজশাহী বোর্ডে এক লাখ ১৩ হাজার ৩৩৮, কুমিল্লায় এক লাখ ৪ হাজার ৪১৮, যশোরে এক লাখ ১৬ হাজার ৭৫২, চট্টগ্রামে ৭৭ হাজার ৭০৯, বরিশালে ৫৫ হাজার ৭৪১, সিলেটে ৫৭ হাজার ৮৮৮ ও দিনাজপুর বোর্ডে ৯৮ হাজার ২৮৭ পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। মাদ্রাসা বোর্ডে এক লাখ সাত হাজার ৫৫৭, কারিগরি বোর্ডে এক লাখ চার হাজার ৬৬৯ এবং ডিআইবিএসে চার হাজার ৯৭৭ পরীক্ষার্থী।
২৫ বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা : উচ্চ মাধ্যমিকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে শুরু হওয়ার তৃতীয় বছরে এসে এবার ২৫ বিষয় পরীক্ষা নেওয়া হবে। এরমধ্যে ২০১২ সালে শুধু বাংলা প্রথম পত্রের সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছিল। ২০১৩ সালে বাংলা প্রথম পত্রসহ মোট সাতটি পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এবার ২৫টি পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে-বাংলা প্রথম পত্র, রসায়ন, পৌরনীতি, ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসায় উদ্যোগ ও ব্যবহারিক ব্যবস্থাপনা, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ এবং কম্পিউটার শিক্ষা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রথমবার উচ্চ মাধ্যমিকে যখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয় তখন চারদিক থেকে এটি বাতিলের দাবি উঠেছিল। অথচ বাতিলের দাবির কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। তিনি বলেন, সৃজনশীল নিয়ে হয়ত অনেক ত্রুটি ছিল, আমরা সেটি দূর করার চেষ্টা করেছি। সৃজনশীল পদ্ধতির উপকারিতা সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, এ পদ্ধতির পড়াশোনায় পাঠ্যপুস্তক ভালোভাবে জানা যায়। এতে যেকোনো জায়গা থেকে প্রশ্ন করলে শিক্ষার্থী উত্তর দিতে পারবে।
উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পরীক্ষায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে অনেক তারতম্য রয়েছে। উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় একজন শিক্ষার্থী কম নম্বর পায় আবার একই প্রশ্নের উত্তর লিখে আরেকজন শিক্ষার্থী বেশি নম্বর পায়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যতটুকু দোষ তারচেয়ে বেশি দোষ শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি যাতে সমান হয় সেজন্য প্রায় ৫শ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, অতীতের মত এবারও সম্পূর্ণ নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্যান্যদের কেন্দ্রে প্রবেশ নিষেধ। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল দেওয়ারও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। নাহিদ বলেন, শ্রুতিলেখক নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী (মূক ও বধির) পরীক্ষার্থীদের জন্য আগের মতো অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকবে। নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, অনেকে বলেন বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী কমেছে। এটা ঠিক নয়, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থীর তুলনায় কম বাড়ছে এটা ঠিক। অন্যান্য বছরের তুলনায় বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী বাড়ছে। বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা দেখতে পাচ্ছি আমরা।
শিক্ষার মান কমেনি : উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, লাখ লাখ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অনায়াসেই উত্তীর্ণ হয়। এই উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে। তবু এরা উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা উত্তীর্ণ। কিন্তু এই উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় তখন বেশিরভাগ অংশ ফেল করে। এতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পদ্ধতি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলেছেন, এই দুই পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে। এতে প্রশ্ন ওঠেছে শিক্ষার মান কমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, এসএসসি ও এইচএসসিতে যে শিক্ষার্থী অনায়াসে জিপিএ-৫ পায় সে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে। তিনি বলেন, পাবলিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে শিক্ষার্থী পাস করানো হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে নম্বর বাড়িয়ে পাস করানো হয় না। এজন্য ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ফেল করে। তিনি বলেন, দুই পরীক্ষায় ‘ফাঁকফোকর’ খুঁজে বের করতে না পারলে পরীক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, এসএসসি ও এইচএসসি’র সনদ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করেই লাভ করে। সব জায়গায় এটি গণ্যও হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এটি গণ্য হয় না। তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বলেছি, আপনারা বলেন, আমাদের ভুল কোথায়? আমরা শুধরে নেব।
তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী ৯৬ ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে এই দুই সার্টিফিকেট পায়। এর বিপরীতে মাত্র এক ঘণ্টার ভর্তি পরীক্ষায় ‘টিক মার্ক’ দিয়ে সে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা-এটা কোন পরীক্ষা? তিনি বলেন, মূলত কোচিং বাণিজ্যের জন্য ভর্তি পরীক্ষা চালু রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা শেষে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ের নামে ৩২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। আমরা চেষ্টা করছি এই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য। একইসঙ্গে শিক্ষার মানও কোনোভাবেই কমেনি বলে দাবি করেন তিনি।
পরিদর্শনে গেলে তারাও খুশি হন… : ‘পরিদর্শনে না গেলে অভিভাবকরা বলেন, পরীক্ষার্থীদের খোঁজ নিলেন না। গেলে অভিভাবকরাও খুশি হন…।’ পাবলিক পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষামন্ত্রীর পরিদর্শনে শিক্ষার্থীদের সময় অপচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একথা বলেন। পরীক্ষার আগের দিন বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরীক্ষার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন শিক্ষামন্ত্রী। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী ছাড়াও জেএসসি-জেডিসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার সময় ঘটা করে শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর কেন্দ্র পরিদর্শনের রেওয়াজ আছে। কেন্দ্রগুলোতে মন্ত্রীর পরিদর্শন ঘটা করে আয়োজন হয়। পরীক্ষা চলাকালে মন্ত্রী নির্দিষ্ট কোনো কোনো পরীক্ষা কক্ষে প্রবেশ করেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। আর ডজন ডজন টেলিভিশন ক্যামেরা মন্ত্রীর পরিদর্শনের এ দৃশ্য ধারণ করে। মন্ত্রীর সঙ্গে থাকেন অন্তত এক ডজন কর্মকর্তা, সঙ্গে থাকেন প্রতিবেদকরাও। পরে কথা বলেন মন্ত্রী, প্রতিযোগিতার যুগে পুরো দৃশ্য সরাসরি সমপ্রচার করা হয় টেলিভিশনে।
মন্ত্রীর পরিদর্শনের ছবি দেখে বোঝা যায়, পরীক্ষার্থীদের চোখে-মুখে থাকে আতঙ্ক আর নার্ভাসনেসের ছাপ। একযোগে দলবদ্ধ কর্মকর্তা এবং মিডিয়া-ক্যামেরা নিয়ে এমন পরিদর্শনে পরীক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় অপচয় হয়, তারা ভয় পান- এমন অভিযোগ থাকলেও তা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার আগের দিন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রীর পরিদর্শনের সংবাদ কাভার করারও আহ্বান জানানো হয়।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ নিজেই বলেন, সকাল ১০টায় তিনি মতিঝিল আইডিয়াল কেন্দ্র পরিদর্শনে যাবেন। এতে শিক্ষার্থীদের
পরিদর্শনে গেলে অভিভাবকরা তাদের কেন্দ্রে দেখে খুশি হন। না গেলে তারা বলেন, একটু খোঁজ-খবর নিলেন না। তবে পরীক্ষার্থীদের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিক যথাসম্ভব বিবেচনা করে পরিদর্শন করা হবে-বলেন নাহিদ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরিদর্শনে যেন ২-৩ জনের মত যাওয়া যায় সেই চেষ্টা করা হবে।
–