মেজর জিয়ার মন থেকে খচখচিটা দূর হচ্ছিলো না। সেনা প্রধান, এজি(এডজুটয়ান্ট জেনারেল)’র মত বড় বড় জেনারেলদের এর আগে কখনও বিনা নোটিশে আসতে দেখেন নি তিনি । তবে ষোল বছর চাকরি জীবনে তিনি একটা জিনিষ শিখেছেন, সেনাবাহিনীতে অযথা কৌতুহল দেখাতে নেই। এখন অবশ্য সময়টা আগের মত নয়। অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানেন বাঙালি সিনিয়ার অফিসাররা এখন মোটামুটি সারভিলেন্সের মধ্যে আছে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আওয়ামীলীগ ভোটে জিতে যাবার পর। তিনি যদিও সিনিয়ার অফিসারদের কাতারে পড়েন না। তবে সামনে প্রমোশন বোর্ড, আর চট্টগ্রামে এক মাত্র
বাঙ্গালি ফাইটিং ইউনিটের সহ অধিনায়ক হিসেবে তাঁকেও রাখা হয়েছে অতসী কাঁচের নিচে।
কাল যখন এম আর চৌধুরির কাছে জেনারেলদের বিষয়ে জানতে চাইলেন, তিনি বললেন ‘আরে মিয়া জেনারেলরা পাকা কুলের মত হয়ে গেছে। যখন ইচছে টুপ করে হেলিকপ্টার থেকে ক্যান্টনমেন্ট পড়ছেন। শালাদের মতলব কিছু একটা আছে।
রাতে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের কাছে গিয়ে তিনি আরেকটু ধন্ধে পড়েছেন। সপ্তাহ দেড়েক আগে কর্নেল চৌধুরির সাথে আলোচনার সময় জিয়া বারবার কমান্ডান্টের মতামত জানতে চাওয়ায় তিনি বলেছিলেন ডু নট ও’রি এবাউট হিম, হি এজ এওয়ার অব দিস হ্যাপেনিংস। কাল মজুমদার এ বিষয়ে কোন আভাস দেননি। যদিও এক বার তিনি বলেছেন কিপ এন আই অন ইউর সিও। তাতে কিছুই স্পষ্ট হয়নি।
মার্চের ১ তারিখে ইয়াহিয়া খানের হঠাত করে এসেম্লি বাতিলের ঘোষণায়, চারিদিকে একটা বিষ্ফোরন্মুখ ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টেও তাঁর ছোঁয়া লেগেছে। পরদিন কর্নেল শিগরির কণফারেন্সে শেখ সাহেবকে গালি দেওয়ায় ইবিআরসির পাঞজাবি অফিসার মেজর মেহের কামালের সাথে বাঙালি ডাক্তার মেজর সিরাজের হাতাহাতি বাধতে গিয়েছিল। আর কোয়ার্টার গার্ডে এটেনশনের বদলে জয়বাংলা বলে হইচই ফেলেদিয়েছিলো ক্যাপ্টেন এনাম। লেঃ কর্নেল এম আর চৌধুরি আর ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের কারণে বিষয়টি বেশি দূর গড়ায় নি।
মেজর জিয়া সেপ্টেম্বরে সেকেন্ড বেঙ্গল থেকে বদলী এসেছেন চট্টগ্রামে। ভালো মন্দ কিছু নয়। ওখানেও সহ অধিনায়ক ছিলেন এখানেও তাই। তবে এখানে চ্যালঞ্জ আর নিঃসঙ্তা বেশি। সেকেন্ড বেঙ্গলে সব কিছু সেট ছিলো। সিও ছিলেন বাঙাি, মেজর মইনুল, মেজর শিশু সবার সাথে তার সম্পরক ছিলো বন্ধুর মত। জুনিয়ারদের মধ্যে ক্যাপ্টেন নাসিমকেও তিনি পছন্দ করতেন। ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে তো পিএমএ থেকেই পরিচয় ছিলো। ৮ বেঙ্গল এখনও পুরোপুরি গোছানাই হয়নি। এরই মধ্যে খাঁরিয়া সেনানিবাসে বদলীর আদেশ হয়েছে। ব্যাটালিয়নের ফায়ার পাওয়ার বলতে শুধুমাত্র কিছু রাইফেল। মেশিন গান নেই, মরটার নেই, এল এমজি আছে কয়েকটা। ৯ জন অফিসারের মধ্যে সিও সহ তিন জন পশ্চিমের। বাঙালি যে ৬ জন আছে তাদের মধ্য শওকতের মতি গতি বোঝা মুশকিল, শমসের মুবিন আর মাহফুজতো খুবই জুনিয়ার, খালিকুজ্জামানকে সে পিএমএ তে ক্যাডেট হিসাবে দেখেছে দুই একবার। কোয়ার্টার মাস্টার অলি আহমেদের সাথেই যোগাযোগটা ভালো।
অলি আহমেদের সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথাও হয়ছে কয়েকবার। তাঁর মাধ্যমে অন্যান্য অফিসারদের মনভাবও জানাগেছে। শেখ সাহেবের ভাষণের পর ৮ তারিখে ইবি আরসির সি আই (চীফ ইন্স ট্রাক্টর) লেঃ কর্নেল এম আর চৌধুরির সাথে তাদের একটা মিটিং হয়েছে। এই মিটং শেষ হয়েছে প্রয়োজনে বিদ্রোহ করার সিদধান্ত নিয়ে। যে কয়টি ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ফাইটিং ট্রুপ্স। এম আর চৌধুরি বলেছেন ‘সমস্যা তো মিয়া একটা নয়। আমার এখানে রিক্রুট আছে হাজারের উপরে, কিন্তু তাদের উপর তো ভরসা করতে পারবা না। ট্রেনিং হইছে মাত্র কয়দিন। যা করার ওস্তাদেরই করতে হবে। তাদের সংখ্যা ১৫০ এর কাছাকাছি। তোমারতো আবার নামকা অয়াস্তা ব্যাটালিয়ন, সৈনিক যদিও দুই কোম্পানি আছে অস্ত্র পাতি তো কিছু নাই। তবে কাজের কাজ করতে পারবে ইপিআর, বয়স কমতো, সেক্টর এডজুটেন্টের তড়পড়ানিটা বেশি, তবে পুরো সেকটরের উপর তার ভালো কন্ট্রোল আছে। আর ওর ট্রুপসের বেশির ভাগই বাঙ্গালি’।। পরে তাঁকে জানানো হয়েছে। তিনিও যোগাযোগটা নিয়মিত রেখছেন ক্যাপ্টেন রফিক ওইদিনের মিটিঙগে ছিলেন না। পরে তাকে সব জানানো হয়েছে। রফিকও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন।
জিয়া ঠিক করলেন সি আই'র সাথে দেখা করবেন, তারপর ডাকবেন ক্যাপ্টেন রফিক কে। ইপিআরের অফিসার হলেও ছেলেটার সাহস আছে।
সূত্রঃ David Ludden;The Politics of Independence of Bangladesh,
The 25/26 March 1971 revolt in Chittagong; Mahmud ur Rahman Choudhury, Time: Flames of Freedom, Beginning of Liberation war in Chittagong, স্মৃতিচারণঃ অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলো- মেজর জেনারেল (অবঃ) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম (Date: 16/12/2007), ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সাথে মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া ও আমার আলাপ চারিতা, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে