DMCA.com Protection Status
title="৭

বাংলাদেশের ‘প্রথম’ প্রধানমন্ত্রী ও প্রথমদিকের কিছু প্রাসঙ্গিক কথাঃ

9883ক্যাপ্টেন (অবঃ)মারুফ রাজুঃ  এবারের স্বাধীনতার মাস মার্চে অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ‘প্রথম’ রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। সে বিতর্কের মীমাংসা এখনো হয়নি। অথচ ‘প্রথম’ কথাটার সঙ্গে ‘নির্বাচিত’ শব্দটুকু জুড়ে দেয়া হলেই মীমাংসা তথা প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব। এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য অবশ্য ওই বিতর্কে অংশ নেয়া নয়। পরিবর্তে এখানে আলোচনা করা হবে বাংলাদেশের ‘প্রথম’ প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে। নাম তার তাজউদ্দিন আহমদ। ১৯৭১ সালের মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জাতিকে যতো ‘সঠিক’ ইতিহাস শেখানোর চেষ্টাই করুক না কেন, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাজউদ্দিন আহমদ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এত সুসংগঠিত ও সুসমন্বিতভাবে পরিচালিত হতো না  এবং এত অল্প সময়ে বিজয় অর্জন করতে পারতো না। স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার গঠন করা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশকে স্বাধীন করা পর্যন্ত সমগ্র কর্মকান্ডে প্রধান এবং সফল নেতা ও নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা অর্জনের ক্ষেত্রেও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযোদ্ধাদেরও তিনিই সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন। এই ভূমিকার জন্যই যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের অবদানের কথা স্মরণ করা দরকার। কারণ ‘সঠিক’ ইতিহাস হলো, স্বাধীনতা কারো ঘোষণা শুনে আসেনি। জনগণও কারো ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি। কলকাতায় অবস্থানরত অস্থায়ী যে ‘মুজিবনগর’ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল  সে সরকারও হঠাৎ করে গঠিত হয়নি। তাজউদ্দিন আহমদের সমগ্র এ কর্মকান্ডের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। ৩ এপ্রিল তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। সে সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায়, পরবর্তীকালের মুজিবনগরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। এসব কারণে বাংলাদেশের জন্য এপ্রিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস, যে মাসের ঘটনাপ্রবাহের প্রধান নায়ক ছিলেন ‘প্রথম’ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। বর্তমান নিবন্ধটি পরিকল্পিতও হয়েছে সে কারণে।
 
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের একেবারে শেষ বাক্যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকে বসেছিলেন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট হাউজে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কোনো পর্যায়েই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। তিনি বরং তার ৭ মার্চের চার দফা দাবি অনুযায়ী সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার সৃষ্টি হবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। প্রথম বৈঠকে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার প্রশ্নে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করতে পারেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
 
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠকে নতুন এক প্রস্তাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দুই অঞ্চলের জন্য দুটি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিলেন, যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’ পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
 
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবেÑ (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
 
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দুটি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলÑ (১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে; এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে সেহেতু প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
 
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউজে আগের দিন ঢাকায় আগত জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হয়েছিল। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো আয়োজন বা সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া পৌঁছে দিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের বৈঠক শেষ হয়েছিল কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া। ২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ ‘কোনো এক সময়’ ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং কবে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি প্রচার করা হবে।
 
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়ার এবং তাদের উপদেষ্টাদের মধ্যকার সমঝোতা অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা কোনো টেলিফোন করেননি, প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কি না। আমি তাকে জানিয়েছি, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ (ড. কামাল হোসেনের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খন্ড, পৃÑ২১০-২৭৮) এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লে¬খযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ রাত দশটার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। তারা যাওয়ার পরপর ইপিআর-এর একজন হাবিলদার এসে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশংকায় ইপিআর-এর সকল বাঙালী সদস্য পিলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এ কথা শুনেই তাজউদ্দিন আহমদ তাদের দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে কামাল হোসেন ধানমন্ডির একটি বাসায় ঢুকেছিলেন দেয়াল টপকে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের উদ্দেশে। (দেখুন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খন্ড) লক্ষ্যণীয়, রাত ১০টার মধ্যে ইপিআর-এর বাঙালী সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার তথ্যটি কিন্তু পিলখানা থেকে ট্রান্সমিটারযোগে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের দাবিকে অসত্য প্রমাণ করে। তাছাড়া, দৈনিক ইত্তেফাকসহ ২৬ মার্চের দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিব ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতার পক্ষে গণহত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে হরতালের ডাক দেয়া এক অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তই বটে! দলের নেতা শেখ মুজিবের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় এর পরের প্রতিটি পদক্ষেপ তাজউদ্দিন আহমদ নিয়েছিলেন একক সিদ্ধান্তে। বিভিন্ন পর্যায়ে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে তার একটি ভাষণও প্রচার করেছিল ভারত সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত সে সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার পরবর্তীকালে এই বৈদ্যনাথতলার নাম করেছে মুজিবনগর।
 
‘সঠিক’ ইতিহাসের মূল্যায়নে সময়োচিত ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে প্রমাণিত হলেও ভারতে চলে যাওয়া থেকে সরকার গঠন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়াটা তাজউদ্দিন আহমদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বরং বাধাগ্রস্ত, সমালোচিত এবং প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একক সিদ্ধান্তে তিনি এমন এক সময়ে সরকার গঠন করেছিলেন যখন আওয়ামী লীগের সব নেতাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং পলায়নরত। শেখ মুজিবের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তাজউদ্দিন আহমদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অনেকেই। শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, খন্দকার মোশতাক আহমাদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা নিজেরাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি তুলেছিলেন। তাদের সঙ্গে উস্কানিদাতার ভূমিকায় নেমেছিলেন সেকালের ‘মস্কোপন্থী’ কমিউনিস্টরাÑ মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। কিন্তু একদিকে তাজউদ্দিন আহমদের নিজের নিষ্ঠা, সততা ও নিখাদ দেশপ্রেম এবং অন্যদিকে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সমর্থন তাকে রক্ষা করেছিল। এজন্যই তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছিল। স্মরণ করা দরকার, স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে সহকর্মিদের অনুরোধেও তাজউদ্দিন আহমদ তার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেননিÑ যদিও তারাও কলকাতাতেই ছিলেন। তার প্রতিজ্ঞা ছিল, দেশকে স্বাধীন না করে তিনি পারিবারিক জীবনের স্বাদ নেবেন না।
 
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে অবশ্য জাতীয় নেতার এই অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদকে করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সংসদীয় গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা যথার্থই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তাজউদ্দিন আহমদকে ক্রমাগত কোণঠাসা করা হয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবও তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে, ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে তাজউদ্দিন আহমদ দুর্ভিক্ষের জন্য প্রকাশ্যে সরকারের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মিদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছিলেন (১৩ অক্টোবর)। তিনি সেই সাথে দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে সর্বদলীয় ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। এটাই তার জন্য ‘কাল’ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। এ সম্পর্কিত চিঠির সঙ্গে পদত্যাগপত্রও পাঠিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব লিখেছিলেন, ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আপনার মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকা সমীচীন নয় বলে আমি মনে করছি। তাই আপনাকে আমি মন্ত্রীপদে ইস্তফা দেয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি। এই সাথে আপনার স্বাক্ষরের জন্য পদত্যাগপত্র পাঠানো হলো।’
 
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর সকাল ১১টায় পাঠানো পদত্যাগপত্রে তাজউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেছিলেন ১২টা ২২ মিনিটে। সে মুহূর্তেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন দেশের প্রথম সফল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। শেষ দিনগুলোতে তাজউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব সম্পর্কে জানার জন্য শেখ ফজলুল হক মনির মালিকানাধীন দৈনিক বাংলার বাণীর একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। পদত্যাগের পরদিনই (১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর) দৈনিকটির সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।’ নিজের দল আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের সম্পর্ক কেমন ছিল তা বোঝার জন্য সম্পাদকীয়র ‘বের করে দেয়া হয়েছে’ কথাটুকুই সম্ভবত যথেষ্ট। বস্তুত এ সময় থেকেই তাজউদ্দিন আহমদ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, রাজনীতি থেকেও তিনি বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাব এবং শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগও মাস তিনেকের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গঠিত বাকশালের সঙ্গে কোনো সংস্পর্শ না থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে অন্য তিন বাকশাল নেতার সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদকেও কারাগারে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।
 
স্বাধীনতা যুদ্ধের অমন একজন প্রধান নেতাকে আওয়ামী লীগ পরবর্তীকালে কিভাবে ‘সম্মান’ দেখিয়েছে সে বিষয়েও কিছুটা উল্লেখ করা দরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮ সালের ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ দেয়া হয়েছিল তাজউদ্দিন আহমদকে। প্রধানমন্ত্রী এই পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ। তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত আটজনের একজন। একই সঙ্গে মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান। এ চারজনই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহকর্মী ছিলেন এবং চারজনকেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অন্য সাতজনের সঙ্গে ‘নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য’ তাজউদ্দিন অহমদকেও এমনভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছিল যেন তিনি কবি-সাহিত্যিক, গায়ক, খেলোয়াড় বা বিজ্ঞানী ধরনের ব্যক্তি কিংবা সেনা অফিসার বা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! বিষয়টি নিয়ে তখনই প্রবল আপত্তি উঠেছিল। বলা হয়েছিল, কেউ কি শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার কথা কল্পনা করতে পারেনÑ তা তিনি যতো ‘অসামান্য অবদানই’ রেখে থাকুন না কেন? উল্লেখ করা দরকার, এই চার জাতীয় রাজনীতিকের সঙ্গে সেবার অন্য তাৎপর্যপূর্ণ পরিচিতির চারজন ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব’কেও ‘নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য’ স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারা ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবতÑ যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা, ছোট ভাই, ফুফাতো ভাই এবং ফুফা।
 
সবশেষে বলা দরকার, সৎ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমদের ছিল দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি রাজনীতি করেছেন দেশ ও জাতির স্বার্থে। অন্য অনেকের মতো ব্যক্তি শেখ মুজিবের চাটুকারিতা করেননি। বাকশালে যোগ দেননি তিনি, মৃত্যুর সময় তিনি বাকশাল সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন না। সুতরাং তাজউদ্দিন আহমদকে ‘নিজেদের লোক’ হিসেবে সামনে আনারও সুযোগ নেই আওয়ামী লীগের। এটাই অবশ্য তাজউদ্দিন আহমদকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে স্মরণ না করার একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আওয়ামী লীগের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চরমপন্থী মনোভাবÑ যেখানে মাত্র একজন ছাড়া অন্য কারো অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার উপাদান নেই। কিন্তু ‘সঠিক’ ইতিহাস কারো ইচ্ছাধীন থাকতে পারে না।
 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!