উনিশশো একাত্তর -৫ :সাইদুল ইসলাম
২৩শে মার্চ ১৯৭১। ব্রিগেডিয়ার মাহামদুর রহমান মজুমদার একটি টেলিফোনের জন্যে সার্কিট হাউসের অফিসে অপেক্ষা করছিলেন। ক্যাপ্টেন মোহসিন তাঁকে কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে, ঢাকার অবস্থা আজ আরও বেশি ভয়াবহ। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্টেডিয়ামে মার্চ পাস্ট করেছে নতুন পতাকা নিয়ে।
দশ প্লাটুন ভলান্টিয়ারও নাকি যোগাড় হয়েছে। ছাত্ররা এর নাম দিয়েছে জয় বাংলা বাহিনী। তিনি মনে মনে হাসলেন, যেমন তিনি ভেবেছিলেন অনেকটা সে রকমই হচ্ছে। কর্নেল ওসমানীর সাথে জানুয়ারি মাস থেকে তিনি যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সিজিএস (চীফ অবজেনারেল স্টাফ) জেনারেল গুল হাসানের একটি চিঠির শেষ দু’টি লাইন ‘under the circumstances we cannot allow the Awami League to form the next Government of Pakistan as that would significantly alter the nature and competence of the Pakistani Armed Forces’ তাঁকে বিচলিত করেছিলো। তিনি প্রথমে সি আই কর্নেল চৌধুরিকে অফিসে ডেকে চিঠিটা দেখিয়েছিলেন। দু’জনেই সিলেটি হওয়ায় তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভালো।
চৌধুরি বললেন স্যার, ‘আপনি তো কর্নেল ওসমানীকে ভালো চিনেন। উনি তো ইলেকশনেও জিতেছেন, ওনাকে ব্যাপারটা জানানো ভালো না? তা হলে শেখ সাহেবও জানতে পারবেন’। সেই থেকে যোগাযোগ শুরু। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে তিনি ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরিকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন রিটায়ার্ড বাঙ্গালি সেনা সদস্যদের লিষ্ট দিয়ে। তাঁর নির্দেশে এই লিষ্টটা খুব গোপনে তৈরি করেছেন এম আর চৌধুরি । তবে আমিন আহমেদ লিষ্টটা সরাসরি ওসমানীর হাতে দিতে পারেন নি। ওসমানীর সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে, আমিনের। তিনি বলেছেন লিষ্ট টা নিরাপদ কোথাও রেখে যেতে, পরে তিনি সেখান থেকে কালেক্ট করবেন।
আমিন বুঝেছেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের এখন পাগলা কুত্তার মত অবস্থা, তিল থেকে তাল হওয়া কোন ব্যাপারই নয়। আর সেটা যদি তাল গাছ হয়ে যায়, তাহলে সকল পরিকল্পনা এবং পরিশ্রম পন্ডশ্রম হয়ে যাবে। মজুমদারের সাথে কথা বলে তিনি লিষ্টটি ধানমন্ডিতে মজুমদারের ভাইএর বাসায় রেখে এসেছিলেন। মজুমদারের মাথায় একটি চিন্তা হঠাতই উকি দিয়ে গেলো, এই ভলান্টিয়ারদের মধ্যে তার পাঠানো তালিকার লোক জন আছে তো? শেখ সাহেব যদি তাঁদের পরিকল্পনায় সম্মতিদেন তখন তো শুধু মহড়া করলে হবেনা। আর দেশের যে অবস্থা শেখ সাহেব যা করবেন বুঝে শুনেই করবেন। চট্টগ্রামে প্রেস কনফারেন্স করে গত বৃহষ্পতিবার মাওলানা ভাসানি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
সেই সরকারের প্রধান হবেন শেখ মুজিব, প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে তাও বলেছেন তিনি। কাঙ্ক্ষিত ফোনটি এলো একটু পর। এম আর সিদ্দিকীর গলায় দারুণ উত্তেজনা। ‘ব্রিগেডিয়ার সাব ঢাকায় তো মনে হয় স্বাধীন হয়ে গেছে। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস না মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জন্ম দিবস। চারিদিকে নতুন পতাকা। পাঞজাবিরা তো মনে হচ্ছে ভেগে গেছে’। মজুমদারকেও ছুঁয়ে গেল উচছাস। – ওনার সাথে কথা হয়েছে? – হয়েছে। উনি সব শুনেছেন, ওসমানী সাহেবও ছিলেন? – ভালো, ভালো উনি রাজী হয়েছেন? কী বললেন একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলেন সিদ্দিকী।‘
উনি বললেন ডায়লগ তো এখনও শেষ হয় নাই। মজুমদাররে ধৈর্য ধরতে বলেন সময় হলে আমি জানাবো’। একটু হতাশ হলেন ব্রিগেডিয়ার, ‘আপনারা বুঝিয়ে বললেন না?’ – তা তো বলছি। ওসমানীও বললেন, মজুমদারের সাথে যোগাযোগ হবে কী ভাবে? সে বুঝবে কী ভাবে সময় হবে কীনা, মুজিব ভাই একটু ভেবে বললেন ঢাকা রেডিও যদি কোন সময় এমনি এমনি ট্রান্সমিশন বন্ধ করে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সময় হইছে’। মজুমদার গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘চিন্তা তো আরও বেড়ে গেলো, সারা দিন ঢাকা রেডিও শোনার জন্যে লোক লাগাতে হবে’। সিদ্দিকী বললেন ঠিক এই কথাটাই কর্নেল সাহেব বলেছেন মুজিব ভাইরে। বলেছেন, ‘ঢাকা রেডিওতো টেকনিক্যাল কারণেও বন্ধ হয়ে যেতে পারে’।
শেষে মুজিব ভাই বললেন, ‘মজুমদার যেন আপনার সাথে আর জহুর হোসেন চৌধুরির সাথে যোগাযোগ রাখে। সে রকম প্রয়োজন পড়লে আমি আপনাদের কারো কাছে মেসেজ পাঠাবো। নুরুল উলারে বলছি সে য্যান আমারে একটা যন্ত্র বানায় দেয়’। মজুমদার চরম অ্বস্তিতে পড়লেন। সময় খুব একটা নেই। সূত্রঃ David Ludden;The Politics of Independence of Bangladesh,Time; Flames of Freedom, আমীন আহমেদ চৌধুরিঃস্মৃতিচারণঃ অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলো, অলি আহমেদঃমুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা আর নয়Interview of Mr M R Siddiquee মুক্তি যুদ্ধের দলিল পত্র ১৫শ খন্ড