ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জানা যায় মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে ক্যালেন্ডার শুরু হয়। আবার কোথাও কোথাও ১৫৮৪ সালের ১১ কিংবা ১২ জানুয়ারির কথা বলা হয়। তবে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ শেষে আকবরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার বছর, অর্থাৎ ১৫৫৬ থেকে এই হিসেব শুরু হয়। সেই সময় ‘লক্ষ্মণাব্দ, বিক্রমাব্দ, জালালি সন, সিকন্দর সন, সপ্তাব্দ, শকাব্দ’ ইত্যাদি ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। সবই প্রধানত রাজাদের শাসনকাল চিহ্নিত করার হিসেব। ভারতে মুঘল রাজত্বের ইতিহাসের এক বিশেষ ঘটনাকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছাড়াও রাজস্ব আদায়ের দিন ঠিক রাখার জন্যও তারিখ-ই-ইলাহি নামে ক্যালেন্ডার শুরু হয়। আকবরের সময়ের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি এবং আকবরনামার রচয়িতা হিসেবে খ্যাত আবুল ফজল এই ক্যালেন্ডার তৈরি করেন।
বাংলা পঞ্জিকার ইতিকথা
সে সময় মাসের নামগুলো ছিল:
১. কারওয়াদিন ২. আর্দি ৩. বোহসু ৪. খোরদাদ ৫. টীর ৬. অমরদাদ ৭. শাহরিয়ার ৮. আবান ৯. আজুর ১০. ডই ১১. আহাম ১২. ইস্কান্দার মিজ
ঠিক কবে থেকে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি মাসের নামের প্রচলন হয়েছে জানা যায় না। তবে, নক্ষত্রের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা এই নামের উৎস খুব সম্ভবত ৭৮ খ্রিস্টাব্দের শক শাসনের সঙ্গে সঙ্গে আসা শকাব্দের হিসেবেই।
নক্ষত্রসূচি ও মাসের নামের সূচিটি যেমন ছিলো:
১. বৈশাখা নক্ষত্র- বৈশাখ ২. জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র- জ্যৈষ্ঠ ৩. শর নক্ষত্র- আষাঢ় ৪. শ্রাবণী নক্ষত্র- শ্রাবণ ৫. ভদ্রপদ নক্ষত্র- ভাদ্র ৬. আশ্বনী নক্ষত্র- আশ্বিন ৭. কৃত্তিকা নক্ষত্র- কার্ত্তিক ৮. অগ্রহায়ণী নক্ষত্র- অগ্রহায়ণ ৯. পুষ্য নক্ষত্র- পৌষ ১০. মঘা নক্ষত্র- মাঘ ১১. ফাল্গুনি নক্ষত্র- ফাল্গুন ১২. চিত্রা নক্ষত্র- চৈত্র
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, বাংলার রাজা শশাঙ্ক এই বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রণেতা। তাঁদের মতে, রাজা শশাঙ্কের আসাম বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ এই ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্য হল এই যে, মহারাজ শশাঙ্ক বেনারস বিজয়ের পর চিল্কাহ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে তা অধিকার করলেও আসামের পথে যাননি। তাই আসাম বিজয়ের সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির তথ্যটি প্রমাণাভাবে ত্যাজ্য হয়েছে। পয়লা বৈশাখের দিনটি নববর্ষ হিসেবে পালনের প্রথা হিসেবে শুরু হয় সম্রাট আকবরের রাজত্বেই। তারিখ-ই-ইলাহি শুরু করার পর সেই সময়ের মুসলমান সমাজে পালাপার্বণের সংখ্যা নির্দিষ্ট হয় বছরে চৌদ্দটি। তার মধ্যে একটি প্রধান উৎসব হল ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ পালন-উৎসব। পয়লা বৈশাখের দিনটিই সেদিন।
এই নওরোজ উৎসবের সময়েই যুবরাজ সেলিম (পরবর্তীকালে সম্রাট জাহাঙ্গীর) মেহেরুন্নিসার (নুরজাহান নামে খ্যাত) প্রেমে পড়েন। বাবার এই নওরোজের উৎসবেই যুবরাজ খুররম (পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান) প্রথম চোখের দেখায় হৃদয় দিয়ে ফেলেন কিশোরী মমতাজ মহলকে। নওরোজ উৎসব না হলে ইতিহাসের পাতায় নুরজাহানই বা কোথায় থাকতেন, কোথা থেকেই বা তৈরি হতো শ্বেতমর্মরের তাজমহল! ভারতীয় সমাজে মুঘল সভ্যতার এক অন্যতম অবদান এই বাংলা ক্যালেন্ডার।
সন-তারিখ:
‘সন’ এবং ‘তারিখ’ শব্দদুটির উৎপত্তি আরবি শব্দ থেকে। ‘সন’ অর্থ বছর, ‘তারিখ’ অর্থ ইতিহাস। ‘সাল’ শব্দটির উৎপত্তি ফার্সি শব্দ থেকে, যার অর্থও বছর। বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তিও আরবি ক্যালেন্ডার ‘হিজরি’ থেকে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রাসূলের (সা) মক্কা থেকে মদিনা যাবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ক্যালেন্ডারের উদ্ভব। মুহররম উৎসবের প্রথম দিন থেকে এই ক্যালেন্ডারের সূচনা হয়। এই হিসেবে প্রথম বাংলা ক্যালেন্ডার শুরু হয় ৯৬৩ হিজরি থেকে, সেই বছরের প্রথম মুহররমের দিন।
যেহেতু বাংলায় ভূমি-রাজস্ব আদায় ঠিক ঠিক করার জন্যেই এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন, তাই একে প্রথম দিকে ‘ফসলি সন’ বলা হতো। মুঘল রাজত্ব শেষ হবার পর ‘ফসলি’ মুছে শুধু ‘সন’ থেকে গেছে।
হিজরি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডারের মূল তফাৎ হল- প্রথমটিতে পৃথিবীকে চন্দ্র-পরিক্রমার সঙ্গে, অন্যটিতে পৃথিবীর সূর্য-পরিক্রমা দিয়ে হিসেব হয়। সেজন্য হিজরি ক্যালেন্ডারে বছরে ১১/১২ দিন কম হয়।
১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাসের এবং দিনের হিসেব তৈরি করে। সেই হিসেব অনুযায়ী বৈশাখ থেকে ভাদ্র হচ্ছে ৩১ দিনের মাস এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র ৩০ দিনের মাস। লিপ-ইয়ারের ৩৬৬তম দিনটি যুক্ত হবে ফাল্গুন মাসের সঙ্গে। বাংলা ক্যালেন্ডারে ‘তিথির’ হিসেব যোগ হওয়া তার অনেক পরে। ‘তিথি’ হল চন্দ্রের পৃথিবী-পরিক্রমার দিনের হিসেব। সেই হিসেবে ৩০ তিথির অর্ধেক ১৫টি ‘শুক্লা’, বাকি ১৫টি ‘কৃষ্ণা’।