উনিশ শো একাত্তর ৭:সাইদুল ইসলাম
মার্চের ২৪ তারিখ সকালে দু’টি হেলিকপ্টার নামার খবর পেয়ে উৎসুক হয়ে উঠলো ইবিআরসির (ইস্টবেঙ্গল রেজিমান্টাল সেন্টার) সবাই। সুবেদার মেজর রুহুল আমিনের অনেকদিন হয়ে গেছে ইবিআরসিতে। কিন্ত এত ঘনঘন হেলি সর্টি দেখেননি তিনি। মার্চের শুরু থেকে সেই যে জেনারেলদের আনাগোনা শুরু হয়েছে তার যেন কোন শেষ নেই। জেনারেলদের এত পরিদর্শনের যত কারনই থাকুক। সিভিলিয়ানদের কাছে অন্য খবর। ১ তারিখে পলোগ্রাউন্ডের কাছে মিছিলে গুলি চালানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত শান্ত হয়নি চট্টগ্রাম। এর মধ্যে আবার করাচী থেকে আসার খবরও মাঝে মধ্যে শোনা যায়। সৈনিক লাইনে বাঙালি – অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে ছোট খাটো ঘটনা নিয়ে খটাখটি বেঁধে যাচ্ছে। অফিসারদের মধ্যেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। মেস হাবিলদারের কাছে খবর পেয়েছেন, ডাক্তার স্যারের সাথে নাকি মেহের স্যারের হাতাহাতিও হয়েছে একবার। সে যাই হোক আজকের ব্যপারটা ভালো ঠেকছে না। চীফ অব স্টাফ সহ ষোল জন অফিসারকে নামতে দেখেছেন তিনি হেলিকপ্টার থেকে। সবাইকে বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যে মনে হলো। কোন অফিসারের সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হত। তিনি হোল্ডিং কোম্পানির অফিসের দিকে রওনা হলেন।
সুবেদার সিরাজের সাথে দেখা হলো অফিসের কাছেই। তিনি বললেন, স্যার কোন খবর পাইছেন?
– কিসের খবর?
– এই যে ১৭ জন অফিসার সাহেবান আসলেন উনাদের উদ্দেশ্য কী?
– ১৭ জন কই, আমি তো গুনলাম ১৬
– এক ব্রিগেডিয়ার সাব পরে নামছেন। ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। উনি মনে হয় সরাসরি পোর্টে গেছেন।
– স্যারেরা কিছু বলছেন, আইজ ইস্পশাল কিছু আছে কী না?
– বললে তো আপনারেই আগে বলতো। আমি কিউ এম (কোয়ার্টার মাষ্টার) স্যারের কাছে আইছিলাম, উনি নাকি অফিসারস মেসে। এসময় নায়েক (ক্লার্ক) মিজান এসে যোগ দিলেন তাদের সাথে। সিরাজ বললেন, মিজান তুমি তো স্যারদেরে সাথে সাথে থাকো, জানো নাকি কিছু? মিজান বলল, তেমন কিছু না। একটু আগে এমটিও (মেকানিক্যাল ট্রান্সপোরট অফিসার) সব ড্রাইভারকে গাড়ির চাবি জমা দিতে বললেন। তারপর পরই ক্যাপ্টিন আমীন সাব এক ড্রাইভাররে বকাঝকা করে একটি সিভিল গাড়ি নিয়ে শহরের দিকে চলে গেলেন।
পোড় খাওয়া মানুষ রুহুল আমীন। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের চেয়েও বেশি দিন চাকরি করেছেন তিনি। বললেন, যা ভাবছিলাম ঘটনা তার চেয়ে খারাপ। সিরাজ স্যার সজাগ থাইকেন। কোয়ার্টার গার্ড আর কোতে যেন ভালো লোক থাকে।
রেলওয়ের ডিএস মকবুল সাহেবের বাসা থেকে জেনারেল ওসমানীকে অনেকবার ফোন করেও তাঁর সাথে কথা বলতে না পেরে ক্যাপ্টেন আমীন আহমেদ চৌধুরির মনে হলো, লাক একটা বড় ফ্যাক্টর। কপাল যেদিন খারাপ থাকে সেদিন সবকিছুতেই গেরো লাগতে থাকে। নাহলে আজ তার এত বড় একটা খুশির দিনে এত সব ঝামেলা হবে কেন? ঢাকা থেকে কর্নেল তাজ ফোন করে জানিয়েছেন তিনি আর্মি এভিয়েশনে সিলেক্ট হয়েছেন।তাকে মেডিকেলের জন্যে আজই ঢাকায় যেতে হবে। তার মানে তাঁর এতদিনের স্বপ্ন এখন পুরণ হবার পথে। তবে তিনি ইবিআরসির ট্রেনিং অফিসারের পাশাপাশি যেহেতু যেডএমেলের স্টাফ হিসাবেও কাজ করছেন, তাই কমান্ডান্টের মতামতটি জরুরী। কিন্তু ঢাকা থেক উড়ে আসা ১৬ জন হাই অফিসিয়ালদের নিয়ে সেই যে তিনি অফিসে ঢুকেছেন আর বের হবার নাম নেই। এদিকে সিআই (চীফ ইন্সট্রাকটর)ও হাতে ব্যথা পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। একিঊ লেঃ কর্নেল ওসমানীর কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু এ মাসের শুরুতে ২০ বেলুচের ইন্ধনে বাঙালি বিহারি দাঙ্গার পর তিনি পাঞ্জাবি অফিসারদের ঘৃণা করতে শুরু করেছেন। ক্যাপ্টেন আমীন সি এম এইচে কর্নেল চৌধুরির কাছে যাওয়ার জন্যে রওনা দেবেন ভাবছেন, এমন সময় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ( কমান্ডান্ট ও যেডএমএলে) অফিসের দরজা খুলে তাঁকে দেখতে পেয়ে কাছে দাকলেন। খুব চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছিলো তাঁর মুখ। বললেন, ‘আমিন, এরাতো আমাকে আজই ঢাকা যেতে বলছে, চিটাগং এ এই অবস্থা। এর মধ্যে আমার ঢাকা যেতে ইচ্ছে করছেনা। না গেলেও বলবে ভায়োলেশন অব গুড অর্ডার, তুমি এখনই গিয়ে কর্নেল ওসমানীর সাথে কথা বলো। যতদূর সম্ভব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জানতে চাইবে আমার কী করণীয়’। পরিস্থিতি বুঝতে আমীনের দেরী হলো না। গত মাসে কমান্ডান্ট একটি পুলিশের গাড়িতে তাঁকে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন, রিটায়ার্ড বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের তালিকা করণেল ওসমানীর কাছে পৌছে দিতে। শেষ পর্যন্ত ওসমানীর সাথে তাঁর দেখা না হলেও, কথা হয়েছিলো টেলিফোনে। ধানঅমন্ডির আর একটা ঠিকানা দিয়ে ওসমানী বলেছিলেন, ‘আমার পেছনে লোক লাগানো হয়েছে। তুমি বরং মজুমদারের ভাইয়ের বাসায় ওটা রেখে যাও পরে আমি কালেক্ট করবো’। কথাটা খুব একটা পছন্দ হয়নি আমীনের। তিনি তালিকাটা পরের ঠিকানায় পৌছে দিয়ে ফিরে এসে মজুমদারকে বলেছিলেন স্যার আমরা মনে হয় একটু বেশি সতর্ক হয়ে পড়ছি। পাঁচ বছরের চাকরির ক্যাপ্টেন সাহেবের কথা শুনে হেসেছিলেন মজুমদার।‘তোমার মত বয়স হলে আমিও তাই ভাবতাম। এর সাথে অনেক কিছু জড়িত। শেখ সাহেব বলার আগে আমাদের কোন ড্রাস্টিক স্টেপ নেওয়া ঠিক হবে না’।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওসমানীর সাথে কথা বলা ঠিক হবেনা। তিনি শহরে যাবার জন্যে গাড়ি খুঁজতেই, ড্রাইভার জানালো, মেজর বেগ গাড়ির চাবি জমা দিতে বলেছে। বেগ পাঞ্জাবি অফিসার। তাঁর এ ধরণের আদেশের পিছনে নিশ্চয় কোন ষড়যন্ত্র আছে। আমীন আহমেদ মারশাল ল’র জন্যে দেওয়া বেসামরিক জীপ নিয়ে রেলওয়ে হিলে ছুটলেন। ওসমানিকে ফোনে না পেয়ে তিনি ভাবতে বসলেন আর কার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা যায়। প্রথমেই মনে হলো সি আই এর কথা। ফোর (৪) বেঙ্গলে আমীনের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। কমান্ডান্টের সবচেয়ে কাছের লোক সিআই কর্নেল এম আর চৌধুরি। দু’জনেই সিলেটি, কোর্সও পিঠাপিঠি। তারপর মনে হলো মেজর জিয়ার কথা, চট্টগ্রামের একমাত্র বেঙ্গল রেজিমেন্টের টু আইসি (উপধিনায়ক) তিনি। তবে চৌধুরির মত ফ্রি নন তিনি জুনিয়ারদের সাথে। জিয়াকে ফোনে পাওয়া গেলো, তিনি বললেন, ‘তুমি কী ব্রিগেডিয়ারআনসারির কথা জানো?’
– না । ওনার কথাতো শুনি নাই।
– আমি শুনেছি উনি কমান্ডান্টের অফিসে যাননি। সরাসরি পোর্টে গিয়েছেন। বাইরে অনেক গুজব। কমান্ডান্ট কে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।
– কমান্ডান্ট তো বললেন ওনাকে ঢাকায় যেতে বলা হয়েছে।
– ঠিকাছে। আমি ইবিআরসিতে আসছি। সিআই আছেন না অফিসে?
– স্যার, আমি সি আইএর কাছে যাব ভাবছি, উনি সিএম এইচে।
– ওকে, প্লিজ কনভে মাই রিগারডস এন্ড লেট মি নো হিজ ওপিনিয়ন এবাউট দিস রিসেন্ট ডেভেলপমেন্ট।
আমীনকে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন, কর্নেল চৌধুরি, হাতে ব্যান্ডেজ নিয়েই এগিয়ে এলেন। সব শুনে বললেন, আমি আজই বেরিয়ে আসব সিএমএইচ থেকে। তিনি বললেন, ‘দুই কোম্পানি তৈরি করে রাখো প্রয়োজনে রেইড করে হলেও ব্রিডেগিয়ার মজুমদারকে তাদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে’। মিসেস চৌধুরির কথা মনে পড়ে গেল, আমীনের। চট্টগ্রামের অবস্থা দেখে কর্নেল সাহেব পরিবার সিলেটে পাঠিয়ে দিয়েছেন ক’দিন আগে। যাবার দিন ওনার মিসেস বললেন, ‘দেইখেন ভাই নিজের নাম মুজিবুর রহমান বইলা উনি তো আবার নিজেরে মজিবার মনে করে। সাবধানে থাকতে বইলেন আপনার স্যার রে’। সিএমএইচ থেকে ফেরার সময় ক্যাপ্টেন আমীন বললেন, স্যার ক্যাপ্টেন রফিককেও খবর দেবো। আমাকেও কম্নডান্ডান্টের সাথে যেতে বলেছে ঢাকায়। আর একটি ট্যাঙ্ক কমান্ডান্টের বাংলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। সব রেডি থাকবে। ঢাকায় গিয়ে দেখি কী অবস্থা, যদি আমাদের এরেস্ট না করে, তাহলে সিচুয়েশন আর এক রকম হতে পারে। আমি ঢাকা থেকে মকবুল ভাইয়ের বাসায় ফোন দিব’।
লাঞ্চে গিয়ে ক্যাপ্টেন এনামের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, মেজর জিয়া হোল্ডিং কোম্পানিতে এসে অনেকক্ষণ তমার জন্যে অপেক্ষা করে চলে গেছে। এনামের সাথে কথা শেষ হতে না হতেই হাজির হলেন ৮ বেঙ্গলের অধিনায়ক। কর্নেল জাঞ্জুয়া, বললেন জিয়াকে দেখেছ নাকি? আমীন বুঝলেন জিয়ার উপর নজরদারি হচ্ছে, বললেন, না দেখা হয়নি। হঠাত মনে হলো মেসের বাইরে থেকে একজন সৈনিক তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এক ছুঁতায় বেরিয়ে এলেন এসে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। সুবেদার মেজর রুহুল আমিন, সুবেদার সিরাজ আর নায়েক মিজান সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অপেক্ষায়। রুহুল আমিন বললেন স্যার আপনাদের যাওয়া হবে না। আপনাদের নিয়ে গিয়ে হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেবে। সৈনিকদের মনোভাব বুঝতে পেরেও দ্বিধায় পড়ে গেলেন তিনি। সুবেদার সিরাজ বললেন, স্যার পাহাড়ের দিকে চাই দ্যাখেন, সৈনিকরা পজিশনে আছে, বড় সাবেদের নিয়ে হেলিকপ্টার নড়া চড়া করলেই শেষ কইরা দিতে পারবে। ব্যান্ডের সৈনিকদের বরদির(ওয়ারদি) মইধ্যেও হাতিয়ার আছে’। আমিন আহমেদ চৌধুরির মনে হলো এমন সমস্যায় তিনি আগে কখনো পড়েন নি। সেনাবাহিনীর প্রায় সব হর্তাকর্তা ব্যান্ডের হালকা মিউজিকের সাথে লাঞ্চ করছে ইবিআরসি মেসে। অস্ত্র লুকিয়ে ব্যন্ড বাজাচ্ছে ব্যন্ড পার্টি, হেলিপ্যাডের কাছে লুকিয়ে আছে সশস্ত্র সৈনিক। এদিকে শেখ সাহেবের ইয়াহিয়া খানের সংলাপ তখনও শেষ হয়নি। শেখ সাহেবের সিগন্যাল এখনো আসেনি। এর মধ্যে কিছু হয়ে গেলে পুরো জাতির সামনে নেমে অন্ধকার নেমে আসবে।তিনি বললেন, আমাদের উপর বিশ্বাস রাখেন। লাঞ্চ শেষ না করেই দৌড়ে সিএমএইচে গেলেন ক্যাপ্টেন আমীন। কর্নেল চৌধুরির হাতের ব্যাথার তখনও উপশম হয়নি। তিনি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললেন, ‘এই অবস্থায় যাওয়া কী ঠিক হচ্ছে? কমান্ডান্টের সাথে কথাও তো বলতে পারলাম না। আমিন, ঢাকায় গিয়ে অবশ্যই আপডেট দিও’।
হেলিকপ্টারে ওঠার সময় আবার এলেন রুহুল আমিন আর সিরাজ বললেন, ‘স্যার আপনাদের মতো বুদ্ধি আমাদের নেই কিন্তু হলফ করে বলছি এই হারামজাদারা আমাদের বলির পাঁঠার মতো ব্যবহার করবে কেন যাচ্ছেন। ’ ’ দূরে এমজিও জেনারেল জানজুয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছিল। আমীন বললেন, ‘সাব, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য এর সাথে জড়িত আমাদের একাকী কিছু করা ঠিক হবে না।’