দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ মুসলামানদের ইমান ও আক্বিদা রক্ষার স্লোগান তুলে ২০১১ সালে আত্মপ্রকাশ করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামের কওমি মাদরাসা ভিত্তিক সংগঠনটি। এটি পরিচলনায় সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী কমিটি বা মজলিসে শুরা থাকলেও এখানে সংগঠনটির প্রধান আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর সিদ্ধান্তই একক ও চূড়ান্ত।
নাস্তিক ব্লাগারদের ফাঁসির দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে হেফাজত হঠাৎ ধুমক্ষেতুর মতো আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে। এরপর ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হস্তক্ষেপে পিছু হটে তারা। ওইদিনের ব্যাপক প্রাণহানীর পর চুপসে গিয়েছিল সংগঠনটি।
হেফাজতের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতাসহ অনেককে মামলার আসামি হওয়ার পাশাপাশি কারাগারের বাসিন্দাও হতে হয়েছিল। ১৩ দফা দাবিকে সামনে নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় সংগঠনটি গতবছর রাজপথ থেকে মিডিয়ায় বেশ দাপটের সঙ্গে মাতিয়ে রাখলেও আহমদ শফীর এক বক্তব্যে পাল্টে গেছে সব হিসাব-নিকাশ।
পুলিশের কঠিন শর্তে মাঠে নেমে গত ১০ এপ্রিল নগরীর লালদীঘির ময়দানে হেফাজত আমির ‘তেঁতুল তত্ত্বের’ পর ‘বন্ধু তত্ত্ব’ শুনিয়ে কর্মী সমর্থকদের অবাক করে দিয়েছেন! ওই দিন বলেছিলেন- ‘হাসিনা, আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগকে যদি আমাদের কেউ শত্রু ভাবেন তাহলে ভুল হবে। তাদের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। তারা আমাদের বন্ধু। এখানে হাসিনা না থাকলেও তার মানুষ রয়েছে।’
এছাড়াও গার্মেন্টসের নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে আলোচিত ‘তেতুল তত্ত্ব’ দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হলেও তিনি এবার দেশের বন্ধ গার্মেন্টস খুলে দেয়ার জন্য দোয়াও করেছেন। এ ঘটনার পর হেফাজত আমিরের হঠাৎ ইউটার্ন নিয়ে নানা আলোচনা ও কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে রাজনীতি সচেতন মহল থেকে শুরু করে খোদ হেফাজতের নেতাকর্মীদের মাঝেও।
এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে হেফাজত ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এসেছে চারটি বিষয়। তা হচ্ছে- পুলিশের করা মামলা থেকে হেফাজত আমির আহমদ শফীর ছেলে হেফাজত নেতা আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাব মুক্ত করা ও হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে করা ৮৩টি মামলা থেকে মুক্তি পাওয়া; আহমদ শফী পরিচালিত হাটহাজারী দারুল মইনুল উলুম মাদরাসার জন্য রেলওয়ের ১৬০ কাঠা জমি ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া; গণজাগরণ মঞ্চকে সরকারিভাবে থামিয়ে দেয়া এবং সরকার থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ গ্রহণ করা।
গতবছর থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে হেফাজত আমির আহমদ শফীর মধ্যে চলা দেনদরবারের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় এ গোপন ‘সমঝোতার’ ফলই হচ্ছে লালদীঘিতে হেফাজতকে দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে মাঠে নামার সুযোগ করে দেয়া এবং সেই সম্মেলনে সরকারের প্রতি আহমদ শফীর পজেটিভ মনোভাব প্রকাশ করা। গোপন সমঝোতার অংশ হিসেবেই সেদিন একাধিক মামলার আসামিদের নিয়ে মঞ্চে বক্তব্য দিলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
জানা যায়, ১৩ দফা দাবিকে সামনে রেখে হেফাজতের ব্যানারে আহমদ শফী দেশের কওমী আক্বিদার আলেমদের নিয়ে আন্দোলন করলেও গত মহাজোট সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর মাধ্যমে শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতেন। ওই সময়েই মাদরাসার পাশে অবস্থিত বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৬০ কাঠা জমি লিজের মাধ্যমে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার নামে সাইন বোর্ড আর পিলার দিয়ে দখল করে নেন। মাদরাসাটির মহাপরিচালক হিসেবে আছেন আহমদ শফী। এমনকি মাদরাসা সীমানার ভেতরেই তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।
হেফাজতের ক্ষুব্ধ একটি সূত্র বলেছে, আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বরাবরই অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। তাকে সব সময় গোয়েন্দা নজরদারিতেও রাখা হতো। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এবং ছেলে বিরুদ্ধে মামলা থাকায় আহমদ শফী সরকারের সমঝোতা প্রস্তাবে রাজি হন। এছাড়াও সরকারের কাছ থেকে তিনি নিজ মাদরাসার নামে ১৬০ কাঠা রেলওয়ের জমি দখলে নেয়ার পাশাপাশি বিশাল অংকের নগদ টাকাও গ্রহণ করেছেন। এসব বিষয় সরাসরি দেখভাল করেন আনাস মাদানী আর সরকারের সাবেক প্রভাবশালী এক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকতা ও জেলার শীর্ষ এক আওয়ামী লীগ নেতা।
এছাড়াও সারাদেশে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে করা তিনটি হত্যা মামলাসহ মোট ৮৩টি মামলা থেকে হেফাজত নেতাদের মুক্তি দিতেও সরকারের কাছে দাবি করা হয়েছে। বিশেষ করে গণজাগরণ মঞ্চকে সরকারিভাবে কোণঠাসা করে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ করতেও সরকারকে শর্ত দেয়া হয়েছে হেফাজতের পক্ষ থেকে। আর সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতকে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে সরে আসার দাবি জানানো হয়েছে।
শুধু তাই নয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে হেফাজত আমীর আহমদ শফীর সুসম্পর্ক থাকায় সেদিক থেকেও সরকারের পক্ষ থেকে একটা চাপ ছিল। সব হিসাব-নিকাশের পর সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে হাঠৎ ইউটার্ন নিয়েছেন আহমদ শফী। সরকারের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ীই তিনি গার্মেন্টস, সরকার ও আওয়ামী লীগ নিয়ে পজেটিভ কথা বলেছেন ওইদিন লালদীঘির ময়দানে।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা আহমদ শফীর প্রেস সচিব আল্লামা মুনীর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
হেফাজতে ইসলামের মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘হেফাজতের সাথে সরকারের কোনো আপোষ বা সমঝোতা হয়নি। আমরা এখনো নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আছি, সামনেও থাকবো। নাস্তিক বিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
সরকার ও আওয়ামী লীগকে আহমদ শফী ‘বন্ধু’ বলা প্রসঙ্গে হেফাজত মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শত্রুতা করতে চাই না। এক দেশে থাকতে হলে সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে হবে। তকে নাস্তিকদের সাথে আমাদের কোনো বন্ধুত্ব হবে না।’
তবে তিনি এটি হেফাজত আমিরের একক সিদ্ধান্ত ও নিজস্ব মতামত বলে দাবি করেন। হেফাজতের আসল বক্তব্য আমিরের পরের দিন শনিবার মহাসচিব জুনায়েদ বাবু নগরীর বক্তব্য বলেই জানান।
ওইদিন বাবুনগরী বলেন, ‘নাস্তিক ও তাদের দোসরদের সাথে কখনো বন্ধুত্ব হতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত এদেশে নাস্তিক থাকবে ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।’ অবশ্য এদিন মঞ্চে থাকলেও কোনো বক্তব্য রাখেননি হেফাজত আমির আহমদ শফী।
সরকারের পক্ষ থেকে আহমদ শফির সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ করা হয় জানিয়ে আজিজুল হক ইসলামাবাদী দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-কর্মকর্তা হুজুরের সাথে সব সময় যোগাযোগ করেন। আর আমাদের সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হুজুর এককভাবেই নিয়ে থাকেন। উনার নির্দেশ মতো নেতাকর্মীরা চলেন।’
তবে হেফাজতে ইসলামের এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মফিজুল ইসলাম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারের সাথে হেফাজতের কোনো সমঝোতা হয়নি। তারা এখন ভুল পথ ছেড়ে সঠিক পথে এসেছেন। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন।’
তিনি বলেন, ‘তাদেরকে এতদিন জামায়াতসহ কয়েকটি দল মিস গাইড করেছিল। দেশের সম্মানিত আলেম সমাজ এখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে দেশের মানুষের পক্ষে এসেছেন।’