বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের কোনো ক্লু এখনো পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের পরিবেশবাদীরা। এ ঘটনা তাদের জীবনের জন্য হুমকির পূর্বাভাস বলে মনে করছেন তারা। জীবন ও বিশ্ব পরিবেশ বাঁচাতে পরিবেশবাদীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নির্বিঘ্নে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি তাদের।
গতকাল বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লার দাপা এলাকার হামিদ ফ্যাশন থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের দেলপাড়া ভূইয়া ফিলিং স্টেশনের কাছ থেকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে আবু বকর সিদ্দিককে।
ঘটনার পর থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের চারটি দল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত তার কোনো হদিশ মেলেনি।
রিজওয়ানা জানিয়েছেন, স্বামীকে অপহরণের পর তাকে ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো মুক্তিপণ দাবি করা হয়নি। এ কারণেই তার ধারণা, তার পেশাগত কারণে অনেকে শত্রু হয়েছে। আর তারাই তার স্বামীকে অপহরণ করেছে।
আর রাজধানীর উপকণ্ঠে প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা সৈয়দা রিজওয়ানার মতো পরিবেশবাদীর স্বামীকে অপহরণ করায় সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন দেশের বাকি পরিবেশবাদী ও পরিবশে আন্দোলনকর্মীরা।
সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক গ্লোবাল উইটনেস নামের একটি সংগঠনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে- বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে গত এক বছরে ৯০৮ জন পরিবেশবাদী খুন হয়েছেন।এর মধ্যে বিচার হয়েছে মাত্র ১০টি মামলার।
সংগঠনটি আরো দাবি করেছে, ভূমি অধিকার ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জড়িতদের হত্যা করার প্রবণতা সারা বিশ্বেই ভয়ানকভাবে বেড়েছে। তারা দেখেছে, ৩৫টি দেশের পরিবেশবাদীরা এখন আগের চেয়ে আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
এসব ঘটনার সঙ্গে বড় ধরনের কোনো সহিংসতার যোগসূত্র নেই। খুনের ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই ক্ষমতাবান ব্যক্তি, কোম্পানি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। ক্রম সঙ্কুচিত সম্পদ নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম প্রতিযোগিতাই এখানে চালকের আসনে। আর অনেক দেশে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সরাসরি কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বলেও দাবি গ্লোবাল উইটনেসের।
লন্ডনভিত্তিক ওই সংগঠনের এমন প্রতিবেদন ভাবিয়ে তুলেছে দেশের পরিবেশবাদীদের। এজন্য তারা গভীর শঙ্কা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চেয়েছেন জীবনের নিরাপত্তা। এ ব্যাপারে বাংলামেইলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসব বিষয়ে কথা বললে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এটা ভায়াবহ একটা ঘটনা। অমরা শুনেছি উনার কোনো শত্রু নাই। তার কোনো অর্থবিত্তও নেই যে সেজন্য তাকে অপহরণ করা হবে। অপহরণের পর মুক্তিপণও চাওয়া হয়নি। তাছাড়া আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তিনি আমাদের সুজনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য। তিনি সব সময় পরিবেশসহ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেন। সে জন্য হয়তোবা দুর্বৃত্তরা তার স্বামীকে অপহরণ করে থাকতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমরা গভীরভাবে চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করবো, সরকার তাকে দ্রুত উদ্ধারে কাজ করবে। এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’
এমন ঘটনা পরিবেশবাদীদের নিরাপত্তা জন্য হুমকি কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা বলা দুরহ। আমরা জানিনা এটা কারা করেছে। তবে আমরা চিন্তিত, শঙ্কিত। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে।’
এ ঘটনা শুধু সৈয়দা রিজওয়ানা এবং তার স্বামীর ওপর আক্রমণ নয় দেশের সব পরিবেশবাদীর জন্য বিষয়টি উদ্বেগের বলে মনে করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের সবার জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এটা শুধু তার ওপর আক্রমণ নয়, এটা আমাদের সবার ওপর হামলা। দুর্বৃত্তরা এমন ঘটনা ঘটিয়ে আমাদেরকে পূর্বভাস দিয়ে দিল। আমরা নিজেরাও খুব চিন্তিত। আমাকে অকেকেই ফোন করে বলছেন, আমরা যেনো সাবধানে চলাফেরা করি। তাছাড়া দুর্বৃত্তরাতো আমাদের পরিবেশবাদীদের পেছনেই লেগে আছে।’
আবু বকর সিদ্দিককে অক্ষত অবস্থায় দ্রুত উদ্ধার ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাক্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহান বলেন, ‘এটা খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা। যেখানে জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। সরকার সেটা দিতে পারেনি। এর পরেও আমরা যাদের প্রতিপক্ষ রয়েছে তাদেরকে আরো সচেতন হওয়া উচিৎ।’
এমন ঘটনা পরিবেশবাদীদের জন্য অশনি সঙ্কেত কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এমন বাস্তবতা থাকতে পারে। এটা কিছুটা হলেও বাস্তব। কারণ আমাদের প্রতিপক্ষ তো অনেক।’
এমন ঘটনায় হতভম্ব ও মর্মাহত বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন। অতিদ্রুত রিজওয়ানার স্বামীকে উদ্ধারে সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তিনি। একই সঙ্গে এটা পরিবেশবাদীদের জন্য সতর্কবার্তা বলেও মনে হচ্ছে তার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।আমরা শঙ্কিত। আমরা আমাদের স্বজনকে ফেরত চাই। এজন্য সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমার স্বামীর কোনো শত্রু নেই। তকে অপহরণ করার মতো আমি ওমন কিছুই দেখছি না। আমার যেটা ধারণা আমার পেশাগত কারণেই তাকে অপহরণ করা হতে পারে। কারণ আমি পরিবেশ ও মানুষের অধিকার নিয়ে সব সময় সোচ্চার ছিলাম। এ কারণেই মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আমার ওপর নাখোশ হতেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘বেশ কয়েক জন আমাকে মোবাইল ফোনে স্বামীর সন্ধানের জন্য কিছু লোককে ধরতে বলেন। অথচ তারা যাদের নাম বলেন তারা উল্লেখযোগ্য কেউ নন। আমি বিষয়টি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না।’
এ ঘটনায় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ৭ থেকে ৮ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্র্যাক সেন্টারে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।সেখানে সৈয়দা রিজওয়ানাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে যোগ দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতিতে (বেলা)। বেলা-ও তখন মাত্র যাত্রা শুরু করেছে।১৯৯৭ সালে বেলার সংগঠক ও প্রধান মহিউদ্দিন ফারুক মারা গেলে রিজওয়ানা কমনওয়েলথ বৃত্তির সুযোগ হাতছাড়া করে বেলার প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন।
১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা পুরান ঢাকায় অন্যায়ভাবে পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রচারকাজ চালাচ্ছিলেন। বেলার মাধ্যমে জনস্বার্থে আদালতে মামলা করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মাইলফলক তৈরি করেন। আদালত একে জনস্বার্থ বিরোধী বলে রায় দেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এজাতীয় কাজ বন্ধে উদ্যোগ নেয়।
এরপর তিনি জাহাজভাঙা শিল্পের মাধ্যমে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনা ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে লড়াই শুরু করেন। বেলার মাধ্যমে ২০০৩ সালে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন তিনি। এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশের নিরাপত্তাহীনতা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, এ শিল্প থেকে যথেচ্ছা বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি কারণে শ্রমিকদের অধিকার আদায়, বিষাক্ত পণ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধে করেন আরো তিনটি মামলা। ২০০৩ সালের মার্চে আদালতের রায়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।সরকার অবশ্য একে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এছাড়াও জলাশয় ভরাট করে আবাসন তৈরি, পলিথিনের যথেচ্ছা ব্যবহার, পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, চিংডির ঘের, সেন্টমার্টিন্ দ্বীপে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে যেখানেই পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানেই সৈয়দা রিজওয়ানার নেতৃত্বে বেলা পরিবেশ রক্ষায় আইনিভাবে লড়ে যাচ্ছে।