উনিশ শো একাত্তর ৮ :সাইদুল ইসলাম
সকালে আবার হেলিকপ্টার নামার খবর শুনে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন মেজর জিয়া। ক’দিন যাবত প্রায় পতিদিনই হেলিকপ্টার আসছে, আর নতুন নতুন গুজব ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রামে। তাঁদের ইউনিটটি সেনানিবাসের বাইরে হওয়ায় খবরের জন্যে নির্ভর করতে হচ্ছে ইবিআরসির অফিসারদের উপর। এদিকে তাঁর অধিনায়ক, লেঃ কর্নেল জাঞ্জুয়া সব সময়ই কোন না কোন অজুহাতে অবাঙালি অফিসারদের জিয়ার কাছে পাঠাচ্ছেন। এমনকি নিরাপত্তার অজুহাতে বিহারি অফিসার ক্যাপ্টেন সাইদকে রাখা হয়েছে মেজর জিয়ার পাশের ফ্ল্যাটে। আসলে যে এসব করা হচ্ছে তাঁর উপরে নজরদারি করার জন্যে জিয়া সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন। মার্চের শুরু থেকেই অলি আহমেদের মাধ্যমে জিয়া অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছেন। পরে তাঁদের সাথে যোগ দিয়েছে, লেঃ মাহফুজ, সমশের মুবিন, চৌধুরি খালেকুজ্জামানরা। মীর শওকত আলী জিয়ার পরে সবচেয়ে সিনিয়ার বাঙালি অফিসার। কিন্তু পুরোনো ঢাকার এই অফিসার ব্যস্ত থাকেন নিজের লাইফস্টাইল নিয়ে। জুনিয়াররা তার আশে পাশে খুব একটা যায় না। জিয়া তাঁর কাছেও ইশারা ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। তবে ১৭ তারিখে স্টেডিয়ামে এম আর চৌধুরির সাথে গোপন মিটিং এর পর বাঙালি অফিসারদের মধ্যে তাঁদের পরিকল্পনাটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে। ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকও আছেন তাঁদের সাথে। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। ২১ তারিখ রাতে কমান্ডান্ট স্পষ্ট কিছু না বললেও, পরে এম আর চৌধুরির সাথে কথা বলে তিনি বুঝতে পেরেছেন সময় হলে কমান্ডান্টও সাথে থাকবেন ।
তবে আজ ক্যাপ্টেন আমীনের ফোনটি তাঁকে বিচলিত করেছে। আগে কিছু না জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে হঠাত করে ঢাকা যাবার নিরদেশ দেবার কারণটি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। জাঞ্জুয়া সকালে একবার তাঁকে ডেকেছিলেন, কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া বাস্কেটবল কম্পিটিশনের প্রস্তুতির খবর নিতে। ইউনিটকে ব্যস্ত রাখার জন্যে সিও একের পর এক প্রতিযোগিতার আয়জন করছিলেন। এর আগে স্পোর্টস অফিসার, ক্যাপ্টেন চৌধুরি খালেকুজ্জামানকে মাটিতে গর্ত করে বক্সিং রিং বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন অধিনায়ক। খালেকুজ্জামানের কাছে বিষয়টি ভালো মনে হয়নি। অধিনায়ক যখন বললেন তাহলে উপর থেকে দর্শকরা ভালো করে দেখতে পারবে, খালেকুজ্জামানের মনে হলো, অধিনায়কের মনে অন্য কোন অভিসন্ধি আছে। জিয়া রেফারি থাকবেন বক্সিঙে। অধিনায়ককে বুঝিয়ে সুজিয়ে শেষপর্যন্ত মাটির উপরই তৈরি করা হয়েছিলো বক্সিং রিং। জাঞ্জুয়া জিয়ার সাথে কথা বলে, ইবিআরসিতে যাবার আগে যখন বললেন পোর্টের তো কোন বন্দোবস্ত করা হলো না’। জিয়া সে কথার কোন উত্তর দেননি। ক্যাপ্টেন আমীনের সাথে ফোনে কথা বলার পরই তিনি হোল্ডিং কোম্পানিতে চলে এসেছিলেন। সেখানেও কারো সাথে কথা না বলতে পেরে একবার ঢুঁ মেরেছিলেন, ইবিআরসি মেসে। কিন্তু ইবিআরসির অফিসার আর চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অধিনায়কদের ছাড়া লাঞ্চে আর কোন অফিসারকে নিমন্ত্রণ না করায় সেখান থেকেও চলে আসতে হয়েছে। হেলিকপ্টার চলে যাবার পর তিনি দেখা করলেন কর্নেল এম আর চৌধুরির সাথে। এম আর চৌধুরি বললেন, তুমি রফিকরে খবর দাও, আমীন ঢাকায় গিয়া ফোন দিবো কইসে, মকবুলের বাসায় সন্ধার পর তুমি আর আমি যামুনে, সেই খানেই আসতে কও। আমি সি এম এইচ থেকে আগে রিলিজ হওয়ার ব্যবস্থা করি।
সন্ধ্যায় কর্নেল চৌধুরির সাথে মকবুল সাহেবের রেলওয়ে হিলের বাসায় এলেন জিয়া। বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পরও আমীনের ফোন এলোনা। এর পর তারা গেলেন রেলওয়ের প্ল্যানিং অফিসার শফি সাহেবের বাসায়। আমীনের ফোন এলো একটু পর। বরাবরের মতই হাসিখুশি আমীন। লেঃ কর্নেল চৌধুরির সাথে কথা হচ্ছিলো তার, ‘স্যার এখনও খাঁচায় পোরেনি আমাদের।কাল পাপা টাইগার (ব্রিগেডিয়ার মজুমদার) যাচ্ছেন সেকেন্ড বেঙ্গলে, ওখান থেকে কর্নেল মাসুদ কে সরিয়ে দিয়েছে। কর্নেল রকিবকে নিয়ে যাবেন তিনি সিও হিসাবে’
– কোন রকিব?
– ওই যে স্যার, ক’দিন আগে ইপি আরে ছিলেন, এখন ৩২ পাঞ্জাবে
– বুঝছি, বাঙালিদের ধোলাই দেবার জন্যে যারে রাস্তার মধ্যে র্যনঙ্ক লাগাইয়া দিছে?
– স্যার?
– তুমি জানোনা? হ্যায় তো ইপিআরে মেজর আছিল, ঢাকা শহরে ডান্ডাবাজি কইরা প্রমোশন পাইছে। সেক্রেটারিয়েটের সামনের রাস্তায় তারে র্য্ঙ্ক লাগাইছে। বাঙালি অফিসারদের কলঙ্ক।
– তা তোমাদের প্ল্যান কী?
– এখনও জানিনা। তাজউদ্দিন সাহেব নাকি একটা আল্টিমেটাম দিয়েছেন। সাংবাদিকদের কাছে শুনছি। কনফেডারেশনের নাকি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
– হুম তাতে কী লাভ?
– স্যার পলিটিসিয়ানরা বলছে, এইডা যদি মেনে নেয়, তা হবে মোর দ্যান অটোনমি
– তাতো বুঝলাম, কিন্তু এই খানে তো আনসারি চইলা আয়সে, হ্যায় ই তো বিকাল থেকে স্টেশন কমান্ডারি করতাসে।
– তোমার মেডিকেলের কী হইলো?
– স্যার, এইটার জন্যে নাকি করাচি যাইতে হবে। কাল সকালে কমান্ডান্ট দেখা করতে বলেছেন। স্যার এদিকে রফিক তো প্রাইম হইয়া বইসা আছে। যে কোন সময় পাঞ্জাবিদের উপর ঝাপ দিয়ে পড়তে পারে। ওরে একটু থামায় রাইখেন। কাল সন্ধ্যার আগে মনে হয় না কিছু বোঝা যাবে, শেখ সাহেব নাকি বলেছেন রবিবারের আগে কিছু হবে না।
আমীনের সাথে কথা বলার পর তিনি জিয়া কে বললেন, ‘রফিকরে খবর দাওনাই?’ জিয়া বললেন, ‘ওর তো এতক্ষণে চলে আসার কথা’।লেঃ কর্নেল চৌধুরি কিছু একটা ভাবলেন তারপর বললেন চল আমরাই ওরে খুঁইজা বার করি। কর্নেল সাহেবের ভক্সোয়াগান একটু শব্দ করে ছুটতে শুরু করলো। রফিকের বাসা সারসন রোডে।
সূত্রঃ Time; Flames of Freedom, আমীন আহমেদ চৌধুরিঃস্মৃতিচারণঃ অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলো, অলি আহমেদঃমুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা আর নয়। ব্রিগেডিয়ার চৌধুরি খালেকুজ্জামানঃ সামরিক জীবনের স্মৃতি, মেজর জেনারেল আমীন আহমেদের সাথে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট ও হালিশহরে আমার কথপোকথন ১৯৯৩।