DMCA.com Protection Status
title=""

জিহাদিরা নয়, মার্কিন ডানপন্থিরাই বেশি বিপজ্জনক

image_87001_0২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার ভয়াবহ হামলার পর পশ্চিমে একধরনের ইসলামভীতি (ইসলামোফোবিয়া) ঢুকে গেছে। বিশেষ করে মার্কিনিদের মধ্যে। ৯/১১ এর আগে ও পরে ইউরোপ আমেরিকায় অনেক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর সেগুলোর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত ছিল। সেসব ঘটনা হতাহতের পরিমাণও কম নয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেসব পশ্চিমা গণমাধ্যমে যেমন গুরুত্ব পায়নি তেমননি গুরুত্ব পায়নি নীতি নির্ধারকদের কাছেও। এমনকি সাম্প্রতিককালে নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর ডানপন্থিদের হামলায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তারপরও কিন্তু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি।





যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যাখ্যাতীত একচোখা নীতির সমালোচনা করে একটি তথ্যভিত্তিক নিবন্ধ লিখেছেন মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন এর জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের পরিচালক পিটার বার্গেন। তাকে সহযোগিতা করেছেন ওই ফাউন্ডেশনের গবেষণা সহকারী ডেভিড স্টারম্যান। তারই বাংলা তরজমা দেয়া হলো-





গত রোববার গ্রেটার কানসাস সিটির একটি ইহুদি কমিউনিটি সেন্টারে এক লোক ১৪ বছর বয়সী এক বালক ও তার দাদীতে গুলি হত্যা করেছেন। এরপর তিনি গাড়ি চালিয়ে পার্শ্ববর্তী ইহুদি রিটায়ারমেন্ট কমিউনিটিতে গিয়ে আরো একজনকে গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ ফ্রেজিয়ার গ্লেন ক্রস নামে এক সন্দেহভাজনকে আটক করেছে। এই লোককে যখন জেলহাজতে নেয়া হচ্ছিল তখন তিনি ‘হেইল হিটলার’ বলে চিৎকার করেন।





এই লোক ফ্রেজিয়ার গ্লেন মিলার নামেও পরিচিত। কট্টর ডানপন্থি হিসেবে বেশ নামডাক আছে তার। সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টারের তথ্য মতে, তিনি কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের ক্যারোলিনা নাইটস এবং হোয়াইট প্যাট্রিয়ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা।





এখন আমরা একটু অন্যভাবে ভাবি- ধরি লোকটি ‘হেইল হিটলার’ বলে চিৎকার করার বদলে ‘আল্লাহু আকবার’ বললো। এর মাত্র দুই দিন আগে বোস্টন ম্যারাথনের বোমা হামলার প্রথম বছর পূর্ণ হলো। মাত্র এই দুটি শব্দের পরিবর্তন হলে কিন্তু বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পেত। এর ব্যাপ্তি হতো ব্যাপক আর বিভিন্ন মাধ্যমে তা কাভারেজও পেত তেমন।





প্রকৃতপক্ষে নাইন-ইলেভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ডানপন্থি আদর্শবাদীদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলাকারীর মধ্যে আছে আধিপত্যবাদী (supremacists), গর্ভপাত বিরোধী, সরকারবিরোধীসহ আরো অনেকগুলো ডানপন্থি গ্রুপ। আল কায়েদার দ্বারা অনুপ্রাণিত বা উদ্বুদ্ধ হয়ে যেসব হামলার ঘটনার ঘটে তার চেয়ে কিন্তু বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এদের হামলায়।  নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৯/১১ এর পর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক কারণে ডানপন্থিদের হাতে নিহত হয়েছে ৩৪ জন সাধারণ মানুষ। বিপরীতপক্ষে আল কায়েদার আদর্শে অনুপ্রাণিতদের হামলায় একই সময় নিহত হয়েছে ২১ জন।





নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ৯/১১ এর পর বাম চরমপন্থি এবং পরিবেশবাদী চরপন্থিরা রাজনৈতিক ইস্যুতে সম্পদ বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু সহিংসতা করেছে। তবে সেগুলো বড় রকমের সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না।





অধিকন্তু ৯/১১ থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী (জিহাদ) কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০ জনেরও বেশি মানুষ অভিযুক্ত হয়েছে বা সাজা পেয়েছে। এরা সবাই সহিংসতার উদ্দেশ্যে রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্র অথবা বিস্ফোরক জাতীয় বস্তু সংগ্রহ করেছিল বা ব্যবহার করেছিল। এর মধ্যে ১৩ জন ডানপন্থি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত, একজন বাম চরমপন্থি এবং দুই জন সাধারণ বিশ্বাসে আস্থাবান এ ধরনের অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন।





কানসাসে ফ্রেজিয়ার গ্লেন ক্রসের মতো একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের আগস্টে। সেসময় উইসকনসিনের গুরুদুয়ারায় (শিখ মন্দির) ওয়েড মাইকেল পেজ গুলি করে ছয় জনকে হত্যা করেন। পেজ ছিলেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী একটি ব্যান্ডের সদস্য এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। হামলার স্থলেই পেজ আত্মহত্যা করেন।





রাজনৈতিক ইস্যুতে এমন ভয়াবহ সহিংসতা ঘটানোর সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ডানপন্থি হিসেবে শুধু পেজই নন এমন আরো অনেকে আছেন। উদাহরণ স্বরূপ: ২০০৯ সালে শাওনা ফোর্ড, অ্যালবার্ট গ্যাক্সিওলা এবং জ্যাসন বুশ অ্যারিজোনার একটি বাড়িতে ঢুকে রাউল ফ্লোরেন এবং তার মেয়ে ব্রিসেনিয়াকে খুন করে। এর তিনজনই তাদের অভিবাসন বিরোধী পর্যবেক্ষক গ্রুপ মিনিটমেন আমেরিকা ডিফেনসের অর্থ জোগার করার জন্য ডাকাতি করতেন। এ ঘটনায় ফোর্ড এবং বুশের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আর গ্যাক্সিওলার হয়েছে যাবজ্জীবন।





এছাড়া ২০০৯ সালে কানসাসের উইচিটায় একটি গর্ভপাত ক্লিনিকের মালিক ডা. জর্জ টিলারকে খুন করেন স্টক রোয়েডার। ২০১০ সালে রোয়েডার খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। সাউদার্ন পোভার্টি ল এর তথ্য মতে, রোয়েডার গর্ভপাত বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুধু তা-ই নয় তিনি গাড়িতে ভুয়া লাইসেন্স প্লেট ব্যবহার করতেন যাতে লেখা থাকতো ‘সার্বভৌম নাগরিক’ (Sovereign Citizens)। এমন লোকেরা তাদের ওপর সরকারের কোনো কর্তৃত্ব মানতে রাজি নন।





৯/১১ এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে ভয়াবহতম হামলাটির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন টিমোথি ম্যাকভেইফ। তার একটি কট্টর ডানপন্থি চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। টিমোথি ১৯৯৫ সালের ১৯ এপ্রিল আলফ্রেড পি মুরাহর সরকারি ভবনে হামলা চালিয়ে ১৬৮ জন মানুষকে হত্যা করেন।





আল কায়েদার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হামলার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে অন্যান্য রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসীদের হাতেই ভয়াবহ সহিংস ঘটনাগুলো অতীতে ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে। কিন্তু গণমাধ্যম এবং নীতি নির্ধারকদের কাছে সব সময়ই জিহাদিস্ট ভায়োলেন্সগুলোই বেশি গুরুত্ব পেয়ে আসছে।





উপরের তথ্য উপাত্ত থেকে বাস্তব পরিস্থিতি সহজেই বোধগম্য হয়। তারপরও ৯/১১ এ আল কায়েদার ১৯ সন্ত্রাসী এক ঝলমলে সকালে ৩ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এরপর আল কায়েদার ইয়েমেন শাখা ২০০৯ সালে ক্রিসমাসের দিন ডেট্রয়েটে একটি মার্কিন বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী জেট বিমানে বোমা পেতে রাখে, এর কয়েক মাস আগে আল কায়েদার পাকিস্তান শাখা নিউইয়র্কের সাবওয়ে (পাতালপথ) সিস্টেমে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা করে। এসব হামলা চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। সফল হলে নিঃসন্দেহে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটতো।





গণমাধ্যমে জিহাদি হামলা অতিমাত্রায় গুরুত্ব পাওয়ার ফলে বিষয়টি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিতে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি কানসাসের ঘটনা জনমনে নতুন প্রশ্ন জন্ম দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডগুলো আল্লাহর নামে অথবা ইহুদি নিধনের মিশন নিয়ে নামা নব্যনাৎসিবাদের মতো রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে-  মানুষের মন এখন এই দুই বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত।





এছাড়া ২০০৯ সালে হোমল্যান্ড সিকুরিটি বিভাগের একটি প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরই মূলত এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে কট্টর ডানপন্থিদের সহিংসতার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। এখন বিষয়টি যৌক্তিক রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি পরে স্বীকারও করেন ওই প্রতিবেদন তৈরির নেতৃত্বাদানকারী ড্যারিল জনসন।





৯/১১ এর পরে কিন্তু আল কায়েদা এবং এর সম্পর্কিত গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে হুমকির ব্যাপারটি বদলে গেছে। ৯/১১ এর পর ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে- এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু আল কায়েদা কোনো হামলা চালাতে সফল হয়নি। এবং ২০১১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়েদা বা তাদের অনুসারীদের যৌথ হামলার রেকর্ড নেই। আজকাল অবশ্য বড় ধরনের কোনো হামলা চালানোর জন্য জিহাদিস্টদের সেভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ খবু কম। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফলতা বলেই মানতে হবে।





যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিককালের আল কায়েদা ধরনের যতো হামলা তার সবগুলোই কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অংশগ্রহণে হচ্ছে যাদের সঙ্গে বিদেশি সন্ত্রাসীদের কোনো যোগসাজস নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করা কঠিন যে, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তায় কেন অভ্যন্তরীণ ডানপন্থি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না যতোটা পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ আল কায়েদা জঙ্গিবাদীরা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!