২৪ মার্চ রাত ২টায়*, ব্রাম্মণবাড়িয়ার নিয়াজ পার্কের কাছের পুলে বাঁধা পেয়ে থেমে গেল মেজর খালেদ মোশাররফের বহর। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কুমিল্লা থেকে ২৮ টি গাড়ি আর আড়াইশ সৈন্য নিয়ে শমসের নগরের পথে রওনা হয়েছিলেন তিনি।
সকালে ফোর (৪) বেঙ্গলে তাঁর অভ্যর্থনাটা ভালো হয়নি। বেশ কয়েক মাস ব্রিটিশ আর্মির সাথে কাটিয়ে মার্চের তৃতীয় সপ্তায় ঢাকায় ফিরেই তিনি শুনতে পেলেন তাঁর পোষ্টিং হয়েছে কুমিল্লায়, ফোর বেঙ্গলের উপঅধিনায়ক হিসাবে। বিদেশে যাবার আগে তিনি ছিলেন ঢাকার ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর। ব্রিগেডের সব অপারেশনের নাড়ি নক্ষত্র তাঁর জানা ছিলো। কমান্ডারসহ অন্যন্য অফিসারদের সাথেও তার সম্পর্ক ছিলো চমৎকার। কিন্তু ফেরত আসার পর থেকে মনে হচ্ছিলো কোথায় যেন একটা ছন্দ পতন ঘটেছে, আসার প্রায় সাথে সাথেই ১৯ তারিখে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়া হলো বদলির আদেশ। কম্যান্ডার বললেন, ‘দেরি করা ঠিক হবেনা। ফোর বেঙ্গল অনেক ঝামেলায় আছে, খিজির প্রায় প্রতিদিনই টু আইসি চাচ্ছে। তুমি দ্রুত গিয়ে জয়েন কর। খালেদ বুঝলেন, তারমানে জয়েনিং টাইম দেওয়া হবে না ( স্থায়ী বদলির সময় গোছগাছ, দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার অফিসারদের কয়েকদিনের ছুটি দেওয়া হয়)। তিনি দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে ঢাকায় রেখে ২২ তারিখে পৌছালেন কুমিল্লায়। প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটির কারণে পরদিন আর অফিসে না গিয়ে ২৪ তারিখ সকালে রিপোর্ট করলেন, অধিনায়ক লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতের কাছে। তিনি বললেন, ‘কত রকম সমস্যায় যে আছি , তুমি এসেছো, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ১ তারিখ থেকে সাদিক নওয়াজ আর শাফায়েত জামিল কোম্পানি নিয়ে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, বামপন্থীদের যে উৎপাত বেড়েছে, তোমাকেও একটি কোম্পানি নিয়ে শমশের নগর যেতে হবে। খালেদ রাজী হলেন না। বললেন, ‘আমি আজ কেবল জয়েন করলাম, এখনও তো কিছুই বুঝে নেই নাই। আর কোম্পানি নিয়ে টু আই সি কে যেতে হবে কেন? জুনিয়ার কাউকে পাঠাই’। খিজির বুঝলেন খালেদকে সহজে সরানো যাবে না। বললেন, ‘ ঠিকাছে তুমি অফিসে গিয়ে দায়িত্ব বুঝে নাও পরে ডাকবো’। অফিসে যাবার সময় খালেদের মনে হলো, তাদের ইউনিটের চারিদিকে অন্য ইউনিটের সৈনিকরা ট্রেঞ্চ খুঁড়েছে।
দশটার দিকে আবার ডাক পড়লো অধিনায়কের অফিসে। খিজির বললেন, ‘কমান্ডার ডেকেছেন’। কুমিল্লার ৫৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি। কুমিল্লা থেকে শুরু করে তার অপারেশনাল এরিয়া উত্তরে সিলেট আর পূর্বে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি খালেদকে বললেন, I have chosen you for a very important task. কিছু বললেন না খালেদ। কমান্ডার বললেন, The situation at Sylhet area is very volatile. The communists are up to something. Although there are 2 EPR companies, but you know they are not dependable. এবারও কিছু বললেন না খালেদ। ইকবাল শফি বললেন, we need a responsible Bengalee officer there. এতক্ষণে মুখ খুললেন খালেদ, ‘ আপনি যে সিচুয়েশন বললেন স্যার, তাতে আমার মনে হয় এক কোম্পানি সৈনিকে হবেনা। আর অটোমেটিকস বেশি লাগবে। যোগাযোগের জন্যে এইচ এফ সেট লাগবে আর ব্যাটালিয়ন মর্টারও নিতে হবে। খিজির আপত্তি করলেন, ‘না এত ওয়েপন নিয়ে কী করবে? খালেদ অনড়, তিনি বললেন কমান্ডার যে সিচুয়েশনের কথা বলেছেন তার মোকাবেলা করতে দিজ আর বেয়ার এসেন্সিয়াল। ইকবাল শফি আর কথা বাড়ালেননা। বললেন গিভ হিম হোয়াটেভার হি ওয়ান্টস’।
ইউনিটে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন গাফফারকে** ডাকলেন খালেদ। ইউনিটের এডজুটেন্ট এই তরুণ ক্যাপ্টেন চোখ-কান খোলা অফিসার। সেনানিবাস এবং সেনানিবাসের বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কম বেশি তাঁর জানা। টু আইসির কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে তিনি পুরো ব্যাটালিয়ন থেকে বেছে ২৫০ জন সৈনিক জড়ো করলেন আলফা কোম্পানিতে। ব্রিগেড থেকে ২৬টি ট্রাক দেওয়া হয়েছিলো পরিবহনের জন্যে সে গুলোর কয়েকটিতে বঝাই হলো এক মাস যুদ্ধ করার মত অস্ত্র, গোলা বারুদ আর রেশন। ব্রিগেড নেটের ভিএইচএফ সেট ছাড়াও একটি এইচ এফ সেট দেওয়া হলো, দূর থেকে যোগাযোগের জন্যে।
এত বড় বহর এমনিতেই ধীরে চলে তারপর আবার পথে পথে ব্যারিকেড সরিয়ে আসতে হচ্ছিলো তাকে। কিন্তু নিয়াজ পার্কের সামনের অভিনব ব্যারিকেডটি তিনি আর পার হতে পারলেন না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্র নেতা হুমায়ুন ও তার সঙ্গী সাথিরা রাস্তার উপর শুয়ে ছিলেন তাদের পথ আগলে। চারিদিকে জনতার ঢেউ দেখে তাঁকে নামতে হলো রাস্তায়।
তিনি বললেন, আমি আপনাদের লিডারের সাথে কথা বলতে চাই। জনতার গর্জনে প্রথমে তাঁর কথা শোনা গেলনা। একটু পর একদল লোক এগিয়ে এসে তাঁকে প্রায় ঘিরে ধরলো। তিনি বললেন, ‘যে কোন একজন কথা বলেন’। জনতা একটু নিরব হলো এ কথায়। যিনি এগিয়ে গেলেন তাঁর নাম লুতফুল হাই সাচ্চু***। ব্রাহ্মণ বাড়িয়া থেকে গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। খালেদ বললেন, ‘আমরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, শমসের নগর যাচ্ছি সরকারি কাজে’। সাচ্চু মৃদু হাসলেন, ‘পাব্লিক তো আপনাদের যাইবার দিতে চায় না’। খালেদ বললেন, ‘আমরা তো আপনাদের নিরাপত্তার জন্যেই যাচ্ছি, আমাদের পথ ক্লিয়ার করার ব্যবস্থা করেন’। সম্মিলিত জনতার মধ্যে থেকে কেউ একজন বললো, কাইল মুজিব ভাই স্বাধীন বাংলার পতাকায় সালাম দিছেন, মিলিটারি বারাইতে পারতো না’। সাচ্চু বললেন, ‘শোনলেন তো পাব্লিকের কথা, হ্যারা রাস্তা ছাড়তো না’।
খালেদ পড়লেন মহা বিপদে। এরই মধ্যে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌছালেন মেজর সাফায়েত জামিল। তিনি মার্চ মাসের শুরু থেকেই কোম্পানি নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। স্থানীয় নেতারা তাঁকে দেখে ভরসা পেলেন ঠিকই। তবু জনতা পথ ছাড়লো না। তিনি খালেদ মোশারফ কে সালাম দিয়ে বললেন, ‘Sir, let’s go to our camp, everything will be settled’.
ক্যাম্পে নেতাদের কথা দিতে হলো, খালেদ এই অস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন না। পরদিন দুপুর দুইটায় পৌছালেন তিনি শমসের নগর।
সূত্রঃ এম আর আখতার মুকুলঃআমিই খালেদ মোশাররফ, মেজর আখতার আহমেদঃ বার বার ফিরে যাই। সিদ্দিক সালিকঃউইটনেস টু সারেন্ডার। মেজর সাফায়েত জামিলের সাক্ষাতকার।
*ইংরেজিতে 2’o clock in the morning on 25th March
* * কর্নেল আব্দুল গাফফার হালদার, এরশাদ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী