দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) প্রতি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এসব ইপিজেডে খালি পড়ে আছে বেশির ভাগ প্লট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কর্ণফুলী ইপিজেডে বিনিয়োগ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। বাড়ছে না কর্মসংস্থানও।
বিভিন্ন রকম সুবিধার কারণে বিনিয়োগকারীরা চায় সমুদ্র্রবন্দরের কাছে কারখানা গড়তে। এমনকি কাঁচামাল আমদানি আর তৈরি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক সময় পূর্বশর্তই থাকে এটি। কিন্তু কাছেই মংলা সমুদ্রবন্দর, এরপরও বিনিয়োগকারীদের কোনোমতেই এটি আকৃষ্ট করতে পারছে না।
১২৪ প্লটের এই ইপিজেড সুপারির মতো অপ্রচলিত পণ্যের কারখানা দিয়ে ভরানো হচ্ছে। একইভাবে উত্তরা ও ইশ্বরদী ইপিজেডেরও বেশির ভাগ প্লট খালি পড়ে আছে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের অন্য ইপিজেডগুলো যখন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে বিপরীত চিত্র এই তিন ইপিজেডে। চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কর্ণফুলী ইপিজেডে অনেক ক্ষেত্রে প্লট দিতে না পেরে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু প্ল�ট খালি থাকার সত্ত্বেও মংলা ও উত্তরাঞ্চলের দুই ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের পাঠাতে পারছে না বেপজা কর্তৃপক্ষ। এ কারণে এই ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগ যেমন বাড়ছে না, তেমনি কর্মসংস্থানও থমকে আছে।
উল্টো গত অর্থবছরে ইশ্বরদী ইপিজেডে কর্মসংস্থান আগের অর্থবছরের তুলনায় এক হাজার ৫৮২ জন কমেছে। আর এ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে মাত্র ৮০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে এ ইপিজেডে। বেপজা সূত্র জানায়, ২০০০-২০০১ অর্থবছরে মাত্র ১০ জন শ্রমিক নিয়ে ১২৪ প্লটের মংলা ইপিজেডের যাত্রা শুরু হয়। প্রায় ১৪ বছরের ব্যবধানে এই ইপিজেডে মাত্র এক হাজার ৬৬১ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। গত অর্থবছরে মাত্র ৯১ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে।
চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নতুন করে নিয়োগ পেয়েছে মাত্র ৯৯ জন শ্রমিক। মংলা ইপিজেডে ১৮টি কারখানা এই মুহূর্তে চালু আছে। আর নির্মাণাধীন পর্যায়ে আছে আরও ১৪টি কারখানা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৩ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার। তবে চালু থাকা ফ্যাক্টরির মধ্যে অন্তত চারটি সুপারি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা।
সমুদ্রবন্দরের খুব কাছে থাকার সত্ত্বেও এই ইপিজেডের করুণ হাল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর বলেন, ‘এখানকার পানি লবণাক্ত। তাই ওয়াশিং কিংবা ডাইং ফ্যাক্টরিগুলো এখানে আসতে চায় না। তা ছাড়া এই ইপিজেডে গ্যাসসংযোগ না থাকাও একটা বড় সমস্যা। আর মংলা সমুদ্রবন্দর পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়াও এই অঞ্চলে বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করেছে।’
খুলনা অঞ্চলে বিনিয়োগের স্বার্থে মংলা সমুদ্রবন্দরকে পুরোদমে চালু করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। রংপুর বিভাগের নীলফামারীতে অবস্থিত উত্তরা ইপিজেডেও কোনো গ্যাসসংযোগ নেই। ২০০০-০১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠিত ২১২ একর জায়গায় ২০২টি প্লটের এই ইপিজেডে বর্তমানে মাত্র ১২টি ফ্যাক্টরি চালু আছে। আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। উত্তরা ইপিজেড থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ৬৫০ কিলোমিটার এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ৫৮৬ কিলোমিটার দূরত্ব থাকার কারণেও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না এই ইপিজেড।
এখানে দক্ষ শ্রমিক সঙ্কটও তীব্র। ফলে গত অর্থবছরে এই ইপিজেডে মাত্র ১৬৯ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর বিগত ১৩ বছরে সর্বসাকল্যে উত্তরা ইপিজেডে ৪৩ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে আট হাজার ৬৭৯ জন শ্রমিকের। মংলা ও উত্তরা ইপিজেডে গত অর্থবছরে নতুন কর্মসংস্থান হলেও ইশ্বরদী ইপিজেডে ঘটেছে উল্টো ঘটনা।
এই ইপিজেডে গত অর্থবছরে এক হাজার ৫৮২ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে অর্থবছর শেষে ইশ্বরদী ইপিজেডে চালু থাকা ৯টি কারখানায় কর্মসংস্থান কমে ছয় হাজার ৭১ জনে দাঁড়িয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেপজার একজন কর্মকর্তা জানান, হংকংভিত্তিক রোশিতা ও মেগাটেক্স নামের দুটি সোয়েটার ফ্যাক্টরি গত বছর তীব্র শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ। এক সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক চাকরি হারায়। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি দীর্ঘ সময়েও বিনিয়োগকারীদের নজরে না পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইপিজেডের আশপাশের অবকাঠামো ও পরিবেশ এখনও বিনিয়োগবান্ধব হয়ে ওঠেনি।
একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীর সেখানে গিয়ে থাকার মতো আবাসন ও আনুষঙ্গিক পরিবেশ এই অঞ্চলে নেই। শহরটা এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি।’ বর্তমানে এই ইপিজেডে বর্তমানে ১৩টি কারখানা চালু আছে এবং ১৯টি কারখানা প্রক্রিয়াধীন। তবে এত কিছুর মধ্যেও আশার আলো দেখছেন বেপজা মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে এই ইপিজেডগুলোয় গতানুগতিকতার বাইরের অনেক ফ্যাক্টরি আছে।
যেমন উত্তরা ইপিজেডে কফিন বক্স, পরচুলা ইশ্বরদী ইপিজেডে জাপানি একটি কোম্পানি ধানের তুস থেকে তেল উত্পাদনের কারখানা খুলেছে। এ কারণে একটু ধীরগতি হলেও এই ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষজন কৃষিকাজে পারদর্শী। তাই এই অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে।
যার কাঁচামাল দেশের মধ্য থেকেই সংগ্রহ করা যাবে।’ এ ছাড়া ভোলা পর্যন্ত গ্যাসসংযোগ চলে আসার কারণে অদূর ভবিষ্যতে মংলা ইপিজেডেও গ্যাস সংযোগ পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া মঙ্গাপীড়িত এলাকার নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিদেশি অর্থায়নে ইশ্বরদী, সাভার ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। আবাসিক সুবিধার এই কেন্দ্র থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে গার্মেন্টশিল্পে কাজ করার সুযোগ পাবে। এর ফলে দক্ষ শ্রমিকের অভাবও দূর হবে বলে তিনি জানান।