আজ বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। যে বিশেষ কারণে এই দিবসটি পালন করতে বিশ্ববাসী উদ্যোগী হয়েছে, সেসব কারণ এখন বাংলাদেশের রাজধানীতে বিদ্যমান। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মৃতনগরীতে পরিণত হতে পারে রাজধানী ঢাকা, যেভাবে একই কারণে সিন্ধু নদী উপত্যকায় আবিষ্কৃত প্রাচীন বসতি মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার জনবসতিহীন বা মৃতনগরী হিসেবে পরিণত হয়েছিল।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার দুই নগরীর নদীসহ সামগ্রিক পরিবেশ জনগণের বিপক্ষে চলে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয় বিশাল জনগোষ্ঠীকে। নিজেদের হাতেই নিজ শহরের পরিবেশ ধ্বংস করে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার জনগণকে অন্যত্র সরে যেতে হয় কোনো এক সময়ে। দেশের পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা যেভাবে রাজধানীর নদী, পানি, বায়ু এমনকি আশপাশে বেঁচে থাকা কিছু জলাশয় দূষণের শিকার হচ্ছে, তাতে একসময় এই এলাকার বাসিন্দারাও ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে।
পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে রাজধানী ইতোমধ্যে তার বাস যোগ্যতা হারাতে বসেছে। সম্প্রতি বিশ্বে বাসের অযোগ্য ১০ শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে কথিত তিলোত্তমা ঢাকা। একটি শহরে কী কী কারণে ইতোমধ্যে অবাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে তার সব চিহ্ন পাওয়া গেছে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায়। গবেষণায় মিলেছে ঢাকার পানি-বাতাস কতটা অনিরাপদ। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে হোনস্টিন ও তার স্বামী বিল প্রথম বুঝতে পারেন যে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন দূষিত হয়ে মানুষের বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আর পৃথিবীতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাও যে বাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে তা ক্রমেই বিশ্ববাসীর কানে চলে গেছে।
১৯৭০ সালে ২২ এপ্রিল আমেরিকায় প্রথম বারের মতো ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। দিবসেরএবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘সবুজ নগরী’। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্বিক দূষণের ভয়াবহ কবল থেকে ঢাকাকে রক্ষা না করা গেলে ঢাকা এক সময়ে স্থবির হয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা এখন অপরিকল্পিত একটি নগরী। একটি নগর যেভাবে গড়ে ওঠার কথা, ঢাকা সেভাবে গড়া হয়নি। এর পেছনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কারণ আছে। ঢাকাতে বাসযোগ্য করতে আমরা কোনো পরিকল্পনাই করিনি। এর পরে রাজধানীকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ড্যাপও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। অপর কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত বিশ্ব। তাদের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সাথে মিলে বাংলাদেশ যৌথভাবে কিছু করতে পারেনি।
এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সব দেশেই শহরে ভিড় জমাচ্ছে। এ কারণে বিশ্বেও অন্যসব শহরের মতো ঢাকায় প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ছে। এই চাপ মোকাবেলা করতে রাজধানীকে পরিকল্পিতভাবে গড়া হয়নি। এতে ঢাকা এখন মানুষের অবাসযোগ্য হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাচ্ছে। ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকাকে সবুজ নগরী হিসেবে গড়তে সময় অপচয় না করে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অন্যথায় ঢাকা বাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমি মনে করি না এখনই এত বড় হতাশার মধ্যে চলে যাবো। আশা করি অবস্থা বদলাবে। মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট করে নিজের বাসস্থান অযোগ্য করতে কেউ চায় না।
তবে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকলে নগরে এ জাতীয় বিপর্যয় হবে না। ব্যবসায়ীদের হাতে রাজনীতি চলে যাওয়ায় এমন হাল হচ্ছে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে এখন পরিবেশ নিয়ে সচেতন মানুষের হার বেড়েছে। তবে নিজেদের প্রয়োজনে ঢাকাকে সব ধরনের দূষণ থেকে রক্ষা করতেই হবে। ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয় যে কারণে ঢাকাকে ঘিরে রেখেছে চারটি বড় নদী আর জলাশয়। এগুলোর পানি বিষে ভরা। নানান ধরনের রাসায়নিকের পাশাপাশি মনুষ্য বর্জ্যে সয়লাবের কারণে এগুলোর পানি মানুষ তো নয়ই পশুপাখিও ব্যবহার করতে পারে না। এমনকি এসব নদীর কোনো কোনো স্থানে জলজ প্রাণীও টিকে থাকতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি বাদ দিয়ে ঢাকার নগরায়ন অব্যাহত থাকলে এক সময় ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ আর বালু- রাজধানীকে ঘিরে রাখা এই চার নদীতে তরল বর্জ্য পরীা করে মিলেছে ভয়াবহ তথ্য। দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া যায়, প্রতি লিটারে মাত্র ০.৪ মি.গ্রা (আদর্শ মাত্রা ৪.৫-৮ মি.গ্রা)। ঢাকা ওয়াসাই স্বীকার করেছে রাজধানীর ৭০ ভাগ এলাকার পয়ঃবর্জ্যই বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীতেই সরাসরি যাচ্ছে। আর এই নগরে প্রতিদিন উৎপন্ন হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য। এর মাত্র ত্রিশ ভাগ শোধনের ক্ষমতা ওয়াসার।
জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, এ অঞ্চলে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীর করুণ দশার মুখে পড়তে যাচ্ছে। অপর দিকে রাজধানীবাসীকে ঘিরে রাখা নদীগুলো তাদের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ দিকে শব্দদূষণেও নগরবাসীর জীবন অতিষ্ঠ। শব্দদূষণ থেকেও রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী। শব্দদূষণের শিকার হয়ে নগরবাসী ভুগছে প্রতিদিন।
শব্দের মাত্রা অনেক স্থানে সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে গেছে। শব্দদূষণে সরাসরি তিগ্রস্তরা হচ্ছে নগরীর ট্রাফিক পুলিশ ও গাড়িচালক। এরপর শিশু-কিশোর, ছাত্রছাত্রী, অসুস্থ ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলাসহ সাধারণ মানুষ, যাদের প্রয়োজনের তাগিদে প্রত্যহ বাসা থেকে বাইরে বের হতে হচ্ছে। ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৬ শতাংশ সাধারণ জনগণ শব্দদূষণকে একটি বড় ধরনের সমস্যা বলে মনে করছে।
ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায় শব্দের মাত্রা ৯৭ ডেসিবেল পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। হাসপাতাল-স্কুল কিছুই মানছে না শব্দদূষণকারীরা। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালের সামনে সর্বোচ্চ ৯৫ ডেসিবেল। ধানমন্ডি ৮ নম্বরে সর্বোচ্চ ৯৪ ডেসিবেল। সাইন্সল্যাব এলাকায় সর্বোচ্চ ৯৭ ডেসিবেল। পান্থপথ এলাকায় সর্বোচ্চ ৯০।
বাংলামোটর এলাকায় সর্বোচ্চ ১০১ ডেসিবেল। চিকিৎসকদের মতে, মানুষের জন্য শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবেল। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ : ঢাকাকে একটি সুন্দর বাসস্থান করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নগর পরিকল্পনায় মিশ্র এলাকা গড়ে তুলতে হবে। যেমন- আবাসন, শিা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাজার, কর্মস্থল, বিনোদন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা কাছাকাছি দূরত্বে থাকে। ঢাকার জলাধারগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে রিটেনশন পন্ড রাখতে হবে।
স্যুয়ারেজ বর্জ্য অপসারণে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরির পদপে নিতে হবে। নাগরিকদের বিনোদনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নগরের পরিবহন পরিকল্পনায় হাঁটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং পথচারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই সব অবকাঠামো নির্মাণ-সংস্কার করতে হবে। ঢাকা শহরের সাথে সাথে দেশের অন্য শহরগুলোর উন্নয়নে জরুরি পদপে নিতে হবে।