দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ এক্সক্লুসিভঃ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের যে কোন সিদ্ধান্তে শুধু শ্রম আইন বাস্তবায়ন সম্পর্কিত নয় বরং বাংলাদেশের দ্রুত গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিষয়টি সার্বিক বিবেচনায় নেয়া হবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। গতকাল স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, শ্রমিক অধিকার ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা বিধানে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনার সঙ্গে সঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে জিএসপি বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক উত্তরণের বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবেই বিবেচনায় আসবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার, শ্রমিকদের জীবন ও কারখানা ভবনের নিরাপত্তা এবং দেশটির গণতান্ত্রিক উত্তরণ- এই বিষয়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অত্যন্ত জোরালোভাবে ও বহুমাত্রিক উপায়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করে যাচ্ছি এবং এই ইস্যুগুলোতে দেশ দু’টির মধ্যে শক্তিশালী আলোচনা বিদ্যমান আছে।
আগামী ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বছরপূতির্র প্রাক্কালে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প শ্রমিকদের মানবাধিকার উন্নয়ন ও পোশাক কারখানাগুলোর
ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পর্যালোচনার লক্ষে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও শ্রম বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে এক টেলিকনফারেন্সের আয়োজন করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উল্লিখিত তিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বাইরে কেবলমাত্র পূর্ব-আমন্ত্রিত কয়েকটি মিডিয়াকে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গ নিউজ, বার্তা সংস্থা পিটিআই ও সিনহুয়ার প্রতিনিধিগণ আমন্ত্রিত মিডিয়া হিসেবে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। টেলিকনফারেন্সে দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ এর এক প্রশ্নের জবাবে কনফারেন্সে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য, শ্রম ও পররাষ্ট্রদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পক্ষে স্টেট ডিপার্টমেন্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি উল্লিখিত মন্তব্য করেন।
এর আগে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক সিনেট কমিটির বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বশেষ শুনানিতে কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর রবার্ট মেনেন্দেজ এই বিষয়টির অবতারণা করেন। ওই শুনানিতে সিনেটের মেনেন্দেজ প্যানেল আলোচকদের কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকার উন্নয়ন ও শ্রমিক নিরাপত্তা বিধানে বিগত ৫ই জানুয়ারির একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ‘ইচ্ছা’ ও ‘সামর্থ্য’ আছে কিনা- সে বিষয়ে জানতে চান।
গতকালের ব্রিফিংয়ের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশকে তা অর্জন করতে হবে। এই মুহূর্তে প্রশাসন চাইলেই জিএসপি ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কংগ্রেসের অনুমতি লাগবে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের শ্রমমান ও ভবন নিরাপত্তা বিষয়ে জিএসপি সাব-কমিটির সুপারিশ লাগবে।
তিনি বলেন, জিএসপি ফিরে পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে বাংলাদেশ বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিছু বিষয় বাস্তবায়ন হয়েছে। আবার অনেকগুলো বিষয় বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের গতি নির্ধারিত সময়সীমার চেয়ে অনেক ধীরগতি সম্পন্ন। এ ছাড়া সার্বিক মানদন্ডের বিবেচনায় এখনও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, কেননা গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয়ে আইন করা হলেও তা কার্যকর না হওয়ায় এর ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়নি বলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে।
‘আগামী মে মাসের শেষের দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ বাংলাদেশ বিষয়ে জিএসপি সাব-কমিটির শুনানি অনুষ্ঠিত হবে’ বলে উল্লেখ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আরও বলেন, টিকফা চুক্তির আওতায় ঢাকায় অনুষ্ঠেয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতেও এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলাদেশের শ্রমমান উন্নয়নে ইইউ-আইএলওকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট-এর কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে জাতীয় শ্রম আইন সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়ন। কিন্তু ইপিজেডগুলোতে স্বতন্ত্র আইনি কাঠামো থাকায় জাতীয় শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আর ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারসহ সংশোধিত শ্রম আইন কার্যকর বাস্তবায়ন নিয়ে এখনও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে। এ ছাড়া সংশোধিত শ্রম আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং বাস্তব ফলাফল নিয়ে আমাদের কোনও ধারণা নেই। বিস্তৃত আকারে শ্রম আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
গত মাসে জেনেভায় বাংলাদেশের সংশোধিত শ্রম আইনের ওপর আইএলও-এর পক্ষ থেকে বেশ কিছু সংশোধনী দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে ব্রিফিংয়ে মার্কিন শ্রম বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখনও সংশোধিত জাতীয় শ্রম আইন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানি না, সুতরাং এর এপ্লিক্যাবিলিটি বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। এ ছাড়া ইপিজেডগুলোর আলাদা শ্রম আইন এবং স্বতন্ত্র কাঠামো শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নকে জটিল করবে বলে আমরা মনে করি।
এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, জিএসপি’র আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই নগণ্য। এমনকি জিএসপি একেবারেই ফিরিয়ে না দিলেও বাংলাদেশের সার্বিক বাণিজ্যের পরিমাণের দিক থেকে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। কেননা এটা পরোক্ষভাবে দেশটির আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের সুযোগ ও পরিবেশকে প্রভাবিত করে। এর নেতিবাচক প্রভাব এমনকি ইউরোপের বাজারেও পড়তে পারে। তাই রাজনৈতিক দিক থেকে ওবামা প্রশাসন কর্তৃক বিগত ৩১শে জুলাই থেকে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত খুবই কার্যকর হয়েছে। তখন থেকেই দেশটি তার শ্রমমান ও কারখানা নিরাপত্তা উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে।
‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র সার্বিক মানবাধিকারের অংশ হিসেবে দেখছে কিনা কিংবা জিএসপি পুনর্বিবেচনায় এ বিষয়টি কোন গুরুত্ব পাচ্ছে কিনা,দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিনিধির এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার, কারখানা নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণ- এই বিষয়গুলোতে যুগপত্ভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বহুমাত্রিক উপায়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছে।
এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করে যাচ্ছি এবং এই ইস্যুগুলোতে দেশ দু’টির মধ্যে শক্তিশালী আলোচনা বিদ্যমান আছে।’ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো চুক্তির (টিকফা) আওতায় ঢাকায় অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে বলে জানান তিনি।
‘বিগত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের প্রায় তিন মাস পর বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখছে’- বার্তা সংস্থা পিটিআই-এর এমন এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখনও আমাদের আগের অবস্থানেই আছি।
বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নে আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যথাসম্ভব দ্রুত একটি ইন্ক্লুসিভ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাই এবং এর বিকল্প কোন ব্যাবস্থা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না। আমরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ আরও প্রশস্ত করার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি রাজনৈতিক অধিকার চর্চার নামে যে কোন ধরনের সহিংসতাকে আমরা নিন্দা করি।
টেলিকনফারেন্স শেষে এই প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মুখপাত্র এমিলি হর্ন বলেন, এই ব্রিফিংটি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমমান ও শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ে পারস্পরিক মতবিনিময়। তাই এ বিষয়ক সংবাদ পরিবেশনকালে কোন কর্মকর্তার নাম উদ্ধৃত না করার অনুরোধ করা যাচ্ছে।