বহুল আলোচিত টিকফা চুক্তির প্রথম অনুষ্ঠিত হচ্ছে সোমবার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো (টিফকা) চুক্তির এ প্রথম বৈঠকে জিএসপিকে আলোচনার প্রধান ইস্যু করতে চায় বাংলাদেশ। কিন্তু শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া আসবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা।বৈঠকে প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসাবে নতুন নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশের উপর চাপ আসতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ১৬টি শর্তের মধ্যে এখনো প্রধান ২টি শর্ত পূরণ করতে না পারাটাই বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া ১০টি শর্ত পুরোপুরি পালন করতে পারলেও অন্যতম ৪টি শর্ত আংশিকভাবে পূরণ করেছে বাংলাদেশ।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিটি পোশাক কারখানার পাশাপাশি ইপিজেডভুক্ত কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করার শর্ত এখনো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। যদিও এক্ষেত্রে গত বছর শ্রমআইন সংশোধন করা হয়েছে। এরপরও কারখানা মালিকপক্ষের বিরোধিতার কারণে শর্তটি পূরণ হওয়া নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে ১৬টি শর্তের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম প্রতিবেদন দেয়া হয় গত বছরের নভেম্বরে। তখনই শর্তগুলো পূরণের জন্য ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল এবং অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল ১৫ এপ্রিলের মধ্যে। সরকার নির্ধারিত সময়েই অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে তবে সবক’টি শর্ত অপূর্ণ রেখেই।
এর মধ্যে পোশাক কারখানা পরিদর্শনের জন্য ২০০ পরিদর্শক নিয়োগের কাজটি বাংলাদেশ এখনো শেষ করতে পারেনি। স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্তও পূরণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জিএসপি ইস্যুতে ছাড় নাও পেতে পারে বাংলাদেশ। তাছাড়া, পোশাক খাতের শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরির কাজটি পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ করতে পারেনি। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিজিএমইএ এ শর্তটি পূরণ করেছে বলে দাবি করবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘টিকফা চুক্তির কারণে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়তে পারে। তবে সেটা রাতারাতি ঘটবে না। এ জন্য সময় লাগবে। এ চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বাড়াতে হলে তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য খাতে শ্রমমান বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আগামীকালের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র যে এ বিষয়ে ছাড় দেবে না- সেটা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আগামীতে তাদের চাপ আরও বাড়বে।’ চুক্তি অনুযায়ী দুই পক্ষকে নিয়মিত পর্যালোচনা বৈঠকে বসেই সমস্যার সমাধান করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
আগামীকাল সোমবার প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধা পেতে যেসব অঙ্গীকার করবে তা কতটা পূরণ করা হচ্ছে, সেটা এ আলোচনায় খতিয়ে দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে কথা দিয়ে তা না রাখার কোনো সুযোগ নেই। শ্রম অধিকারের বিষয়ে তারা দাবি করবে স্বচ্ছতা। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিতেই হবে। এসব বিষয় নিশ্চিত না হলে বৈঠক তেমন ফলপ্রসু হবে না বলে মনে করেন ড. ইমতিয়াজ।
এদিকে, বৈঠকের আগের দিন রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরিপোশাক রপ্তানি করছে। সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম শুল্ক প্রদানকারী দেশ। এছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরও বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে টিকফা ফোরামের প্রথম সভায় বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি, এর মাধ্যমে জিএসপির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং দু’দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘রানাপ্লাজা দুর্ঘটনা থেকে বাংলাদেশ অনেক শিক্ষা নিয়েছে। মালিক ও শ্রমিকদের সতর্কতায় গত একবছরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ শিল্পের চলমান সমস্যা সমাধানে সরকার প্রয়োজনীয় সবকিছু করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষ থেকে জিএসপি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়কে সামনে রেখেই আলোচনা করা হবে।’
এদিকে সফররত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের প্রধান মাইকেল জে ডিলেনি মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার ভবন অডিটরিয়ামে রোববার দুপুরে প্রথম টিকফা পরিষদ সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার আদায়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছে। এ জিএসপি ফিরে পেতে অ্যাকশন প্লান অনুযায়ী বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে- শ্রমিক, অগ্নি নিরাপত্তা ও ভবনের মান উন্নয়ন, শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে ইউনিয়ন গঠন ও সমষ্টিগতভাবে দর ঠিক করার ক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করা এবং শ্রমিক আইন পুনর্গঠন করা।’
উল্লেখ্য, জিএসপির আওতায় বছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ৩ কোটি মার্কিন ডলারের সুবিধা পেয়ে থাকে।জিএসপি সুবিধাভোগী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপি বিশেষ মর্যাদা লাভ করে থাকে।
বহু আলোচনা সমালোচনা ও বামপন্থিদের বিরোধিতার মুখে ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি মূলত কিছু সুনির্দিষ্ট বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরো বাড়ানোর জন্য কাজ করবে। চুক্তি স্বাক্ষরৈর দিনই প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি না থাকায় বৈঠকটি ঢাকায় অনুষ্ঠানের আগ্রহ জানায় বাংলাদেশ।
সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এই ফোরামের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে