মহানগর বিএনপি নেতাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান দুই নেতার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটতে চলেছে আর এ অনুভূতি থেকেই চাঙা হচ্ছে ঢাকা মহানগর বিএনপি।
মহানগর বিএনপিতে যে কয়জন প্রভাবশালীর নাম শোনা যায় তাদের মধ্যে অন্যতম দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। গুঞ্জন রয়েছে, এই দুই নেতার দ্বন্দ্বে ঢাকা মহানগর বিএনপি বিগত আন্দোলন সংগ্রামে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের কর্মসূচিতে এই কমিটির ব্যর্থতার কারণে দলের সব পর্যায় থেকে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
খালেদা জিয়া এই কমিটি ঢেলে সাজানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও অনেক ক্ষেত্রে তা আলোর মুখ দেখছে না। নানা সমালোচনার মুখে দীর্ঘদিন নগর কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকা ঢাকার সদ্য সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এই পদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার ঘোষণা দেন। নতুন কমিটিতে নানা জনের নাম শোনা যায়।
তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নগরের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার ঐক্য সুদৃঢ় হচ্ছে। একত্রে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। গত সোমবার নয়াপল্টনে শ্রমিক দলের একটি সংবাদ সম্মেলনে এই দুইনেতার আগমনে কর্মীরা স্বস্তি পেয়েছিলেন।
জানা গেছে, পহেলা মে শ্রমিক সমাবেশ সফল করতে মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। তাদের লক্ষ্য মে দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সমাবেশ করবেন, খালেদা জিয়ার সমাবেশে অন্তত তার চেয়ে ৩/৪গুণ বেশি জনসমাগম ঘটানো। খালেদা জিয়ার সমাবেশ সফল করতে মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা মহানগর বিএনপির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন উভয়েই বক্তব্য দেন।
৫ জানুয়ারির পর এটাই ছিল ঢাকা মহানগর বিএনপির প্রথম কোনো যৌথসভা। আব্বাস এবং খোকার অনুসারীদের সম্মিলিত উপস্থিতি নগর বিএনপিকে চাঙা করে তুলেছে। অন্যান্য কর্মসূচির চেয়ে এই যৌথসভায় অসংখ্য নেতাকর্মী দেখা গেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিল সতর্ক। যৌথসভা শেষ হওয়ার পর নেতাকর্মীদের নয়াপল্টনে জড়ো হতে দেয়নি পুলিশ। তারপরও কর্মীদের চোখে মুখে ছিল স্বস্তির উচ্ছ্বাস। খোকা-আব্বাস একসঙ্গে: বাঘে-মহিষে একঘাটে জল পানের মতো ঘটনা যেন!
এ ব্যাপারে পল্টন থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আলম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুই নেতার ঐক্যে আমরা আনন্দিত। এতোদিন আমরা এটিই চেয়েছিলাম।’
এতো দিনের দ্বন্দ্ব কীভাবে মিটলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবই ম্যাডামের নির্দেশে হয়েছে। দেশে গুম-খুন চলছে। অবৈধ সরকার পতনের আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে ঐক্যের বিকল্প নেই।’
শাহবাগ থানা বিএনপির সদস্যসচিব এম হান্নানও তার খুশির কথা জানালেন। এই মুহূর্তে এমন ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করলেন তিনি।
মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকা একত্রে কাজ করছেন। কীভাবে এই পরিবেশ সৃষ্টি হলো এমন প্রশ্নের জবাবে এম হান্নান বলেন, ‘মির্জা অব্বাস স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাদেক হোসেন খোকা কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান। সে তুলনায় আমি একজন চুনোপুঁটি, ইউনিট পর্যায়ের নেতা। তাদের নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’
নগর সূত্র জানিয়েছে, মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকা দলের জন্য নয়, বরং তাদের পদ-পদবী আর অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই একত্রিত হয়েছেন। রাজপথে আগের মতো এই দুই নেতার তেজস্বিতা নেই। বার্ধক্য এবং সরকারি বাধার কারণে তারা ঘরমুখি ছিলেন। প্রভাব ধরে রাখতেই যে তারা একত্রিত হয়েছেন তার প্রমাণ হলো- গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগর বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করার কথা ছিল। কিন্তু অনুমতি না মেলায় প্রেসক্লাবে করতে হয়েছে। আব্বাস-খোকা যদি দলের জন্য একত্রিত হতেন তাহলে নেতাকর্মীরা সেসময় রাজপথে প্রতিবাদ করতে নামতেন। তারা কারাবরণ করতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু প্রেসক্লাবে সমাবেশ করায় আন্দোলন আর জমেনি।
সূত্র আরো জানায়, মহানগর কমিটির নেতৃত্বের জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক হাবিব উন নবী খান সোহেলসহ বেশ কয়েকজনের নাম শোনা যায়।
তবে যে-ই নেতৃত্বে থাকুন না কেন আব্বাস-খোকা উভয়ের হিসাবে নগরের খেলায় সদস্য সচিব আব্দুস সালাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সালাম দীর্ঘদিন খোকার সঙ্গে কাজ করছেন। আব্বাসের সঙ্গেও বৈরিতা নেই। তিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভালোই খেলছেন। তাছাড়া কমিটি থেকে যদি সালাম বাদ পড়েন তবে তিনি আব্বাসের সঙ্গে যোগ দিবেন। ফলে খোকা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। আবার তাকে রাখলে তা খোকার জন্যই লাভ। এই সমীকরণে আব্বাস-সালামের দূরত্ব কমে গেছে। আর তার প্রভাব গোটা মহানগর রাজনীতিতে পড়েছে।
পদ বাঁচানো হোক আর দলের স্বার্থেই হোক সার্বিক পরিস্থিতিতে মহানগর নেতাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হচ্ছে। জানা গেছে, মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার দ্বন্দ্ব নিরসনে আব্দুস সালামের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। যৌথসভায় আসার জন্য আগের দিনই মির্জা আব্বাসকে সালাম বলে রেখেছিলেন। যৌথসভা শুরুর কিছুক্ষণ আগেও আব্দুস সালাম মির্জা আব্বাসকে আসার জন্য ফোন করেন।
নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে আব্দুস সালাম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশে গুম, খুন বাড়ছে, বিরাজ করছে এক অসহনীয় অবস্থা।এসময় সকল মতপার্থক্য ভূলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকার পতনের আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে হবে।