DMCA.com Protection Status
title="৭

গুম,খুন,গুপ্তহত্যাঃ কি হচ্ছে দেশে??

pd_1524762922_1374318561বর্তমান সরকারের শাসন আমলের সাথে গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা সমার্থক হয়ে গেছে বলেই অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষের। গুম ও হত্যার জন্য সরকারকে দায়ী করার মানুষও নেহায়ত কম নয়। গুম, অপহরণ ও বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনার আধিক্যের কারণে সাধারণ জনতা  থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই ভুগছেন গুম আতঙ্কে। গত সপ্তাহের বালাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি 'বেলার' নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকের ‘অপহরণের’ ঘটনায় জনমনে গুম আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।সর্বশেষ গতকাল একদিনেই নারায়নগন্জ থেকে  নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবি চন্দন সরকার সহ  মোট ৬জনকে অপহরন করা হয়েছে ,যাদের হদিশ এখনও মেলেনি।

ঘটনার ৩৬ঘন্টা পর আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও এই আতঙ্ক জনমনে স্থায়ীরুপ ধারণ করেছে বলেই বিভিন্ন মহলের অভিমত। সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসেবে, দেশের আইন শৃঙ্খলার উপর নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। আইন শৃঙ্খলার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণেই এমন অপহরণ ও গুমের ঘটনা ঘটছে বলেই তাদের মতামত।

বাংলাদেশের রাজনীতির অনুসঙ্গে পরিণত হয়েছে গুম। আর বছরের পর বছর গুম ব্যক্তির অপেক্ষায় থাকার পরে মেলে না কোন সন্ধান। গুমের ঘটনার তদন্তের কোন অগ্রগতি হয় না। বরং সময়ের সাথে সাথে ফাইল চাপা পড়ে যায় গুমের ঘটনা। পরে আবার যখন আলোচিত কোন ব্যক্তি গুমের শিকার হন, তখনই উঠে আসে পুরনো নানান ঘটনার প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া তেমনই কিছু গুমের ঘটনা নিয়ে নতুনদিনের বিশেষ প্রতিবেদন।

আবু বকর সিদ্দিক:


গত ১৬ই এপ্রিল রোজ বুধবার বেলা আড়াইটার অপহৃত হন আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী। অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ভুঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে তাকে ‘অপহরণ’ করে। আবু বকর সিদ্দিক ফতুল্লা পোস্ট অফিস মোড়ে অবস্থিত রপ্তানিমুখী হামিদ ফ্যাশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক। অপহরণের পর থেকে এখনও পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। রিজওয়ানা হাসান এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেছেন। মামলার পরে রিজওয়ানা হাসানের ফোনে একাধিকবার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এই আইনজীবীর। এছাড়া নারায়ণগঞ্চের ওসমান পরিবার এই গুমের সাথে জড়িত বলেই অভিযোগ এই আইনজীবীর। ১৮ তারিখ শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে আবু বকর সিদ্দিককে মিরপুরের আনসার ক্যাম্প এলাকায় নামিয়ে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। তবে কে বা কারা তাকে অপহরণ করেছিল তা জানা যায়নি।

ইলিয়াস আলী:


২০১২ সালের ১৭ এপিল রাজধানীর বনানী থেকে নিখোঁজ হন তৎকালীন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক। ২ বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনও ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালকের কোন খবর মেলেনি।


বিএনপির আন্দোলন ও সিলেট বাসীর অবরোধের পরেও ফিরে আসেনি বিএনপির এই নেতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কেউই এ ঘটনার কোন কিনারা করতে পারেনি। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও সন্তানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে এই বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু ২ বছর পার হয়ে গেলেও আজো রহস্যের আবৃত্তে বন্দী রয়ে গেছে সারাদেশে আলোড়ন তোলা ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা।

আমিনুল ইসলাম:


গাজীপুরে পোশাক শ্রমিক নেতা আমিনূল ইসলামকে ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় অপহরণের শিকার হন। তিনি শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন’র (বিসিডব্লিউএস) শীর্ষস্থানীয় নেতা। অপহরণের পরদিন ৫ এপ্রিল সকালে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে ব্রাহ্মণ শাসন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনের রাস্তা থেকে আমিনুলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ এপ্রিল তার লাশ সনাক্ত করা হয়। এই হত্যা রহস্য পুলিশ এখনও পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি।

চৌধুরী আলম:


চৌধুরী আলম ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। ২০১০ সালের ২৫ জুন রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেটকারযোগে ধানমন্ডি যাওয়ার পথে তিনি নিখোঁজ হন। পরে পরিবারের তরফ থেকে রাজধানীর শেরে বাংলানগর থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ফার্মগেট থেকে সাদা পোশাকধারী একদল ব্যক্তি নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে চৌধুরী আলমকে তুলে নিয়ে যায়। অদ্যাবধি তিনি কোন হদিস মেলেনি। তিনি জীবিত না মৃত তারও কোন হদিস নেই। পরবর্তীতে চৌধুরী আলমের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি রাজধানীর কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবনের কাছ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়।

সাইফুল ইসলাম:


২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায় সাবেক সাংসদ এবং লাকসাম বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবিরকে। চার মাস পেরিয়ে গেলেও তাঁদের খোঁজ মেলেনি।

রফিকুল ইসলাম মজুমদার:


২০১৩ সালের জানুয়ারির ৬ তারিখ গুম-হত্যার শিকার হন ঢাকার বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদার। ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার আনন্দনগর গ্রাম থেকে সাদা পোশাকধারী একদল লোক র্যাব পরিচয়ে তাকে অপহরণ করে বলেই অভিযোগ। পরে কুষ্টিযার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের আদাবাড়িয়া গ্রামের মাঠ থেকে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার হাতকড়ায় ‘পুলিশ’ শব্দটি খোদাই করে লেখা ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত হয়।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮ জন অপহরণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় ২৪ জনকে। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো খোঁজই নেই। তাঁরা বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন, সেটি আজো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি পরিবার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

এছাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলার ঘটনা ও বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। অনেকেই আবার অভিযোগ করেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাই গুমের সাথে জড়িত। ফলে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শান্তি ও নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। রাষ্ট্রজনরা জানেন না, কোথায় কিভাবে তাদের জন্য ওত পেতে আছে গুম ও অপহরণ চক্র। মানুষের এমন ভয়াল জীবনের দায়ভার অবশ্যই বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। কেননা রাষ্ট্রজনদের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!