ভারতের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর তর্জন-গর্জন যত বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে, শরণার্থী ও অনুপ্রবেশ নিয়ে ক্রমশ সুর নরম করছে দেশটির কট্টরপন্থি দল বিজেপি। উল্টো দিকে, বিজেপি মানুষে-মানুষে বিভাজনের চেষ্টা করছে বলে সুর চড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিন কয়েক আগেই পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরের সভায় বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি বলে গিয়েছিলেন, ‘১৯৪৭ সালের পরে যারা ভারতে এসেছেন, তারা বিছানা-বেডিং বেঁধে রাখুন। ১৬ মের পরে তাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে।’
কিন্তু শুক্রবার পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে এক জনসভায় বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘কারও উপরে অত্যাচার হবে না। কিন্তু যারা বিনা ভিসা-পাসপোর্টে এখানে এসেছেন, তাদের ওখানে (বাংলাদেশ) ফিরে যাওয়াই উচিত। আমরা তাদের চিহ্নিত করব।’
এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারীদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর নীতি নিয়ে চিরকালই চলেছে বিজেপি। এনডিএ সরকারের সময় দিল্লি-মুম্বাইয়ে এ রকম কিছু লোককে আটকও করা হয়েছিল। যদিও এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ভাবে সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি রয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধী দলগুলির।
তাই শুক্রবার খড়্গপুরে মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘কেউ কেউ চান, দুই বাংলা হিন্দু-মুসলিমে ভাগাভাগি হয়ে যাক। আমি জানি, আপনারা বঙ্গভঙ্গ চান না। আমার কাছে নির্দিষ্ট খবর রয়েছে, দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। আমরা দাঙ্গা লাগাব না। দাঙ্গা লাগানো আমার উদ্দেশ্য নয়।’
উল্লেখ্য, আগামী ১২ মে রানাঘাট, বনগাঁ বা বসিরহাটের মতো বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কেন্দ্রগুলিতে ভোটগ্রহণ করা হবে। এদিন কেশিয়াড়িতে রাজনাথ অবশ্য দাবি করেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ করার পার্টি বিজেপি নয়। বিজেপি এই রাজনীতি করে না। আমরা মানুষকে সুবিচার দিই। মুসলমানরা ভারতের যে রাজ্যেই থাকুন না কেন, সুরক্ষিত থাকবেন।’
কিন্তু পাশাপাশি তিনি এও জানাতে ভোলেননি যে হিন্দুরা বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদেরই বিজেপি শরণার্থীর চোখে দেখে। রাজনাথ বলেন, ‘হিন্দুরা যারা এসেছেন, তারা শরণার্থীই। অত্যাচারের জন্যই তারা এ দেশে চলে আসতে বাধ্য হন।’
বারাসতে এক কর্মিসভায় বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অনন্তকুমারও বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু শরণার্থীরা আমাদের ভাই। কলিজার টুকরা। তাদের আমরা নাগরিক সম্মান দেব। কিন্তু যারা এ দেশে উৎপাত করবে তাদের আমরা আসাম, বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন কোণা থেকে খুঁজে ফের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেব।’
এ নিয়ে বৃহস্পতিবারই পুরুলিয়ার রায়বাঘিনী ময়দানে মমতা বলেছিলেন, ‘দিল্লি-মুম্বাইতে কাজ করলে ওরা (বিজেপি) আগে বাংলার ছেলেদের ট্রেনে তুলে পাঠিয়ে দিত। ভুলে গিয়েছেন? নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার আগেই বলছে বাক্স-প্যাটরা নিয়ে পাঠিয়ে দেব।’
এদিন বারাসতের বিজেপি প্রার্থী, জাদুকর পিসি সরকার অবশ্য দাবি করেছেন, বিজেপি আসলে শরণার্থী প্রেমী। তিনি বলেন, ‘মোদি যে শরণার্থীদের ভালবাসেন তার বড় উদাহরণ আমি নিজেই। আমি বাংলাদেশে থেকে আসা শরণার্থী। উনি যে শরণার্থীদের কতটা ভালবাসেন তা আমাকে টিকিট দিয়েই প্রমাণ করে দিয়েছেন।’
বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াচ্ছে বলে মমতা যখন সুর চড়াচ্ছেন, তার বিরুদ্ধে প্রাদেশিকতার অভিযোগ এনেছে বিজেপি। শ্রীরামপুরে নরেন্দ্র মোদি কটাক্ষ করেছিলেন, মমতা ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। বিহার, উরিষ্যা থেকে গরিব মানুষ এই রাজ্যে কাজে এলে ওর রাগ হয়। হেনস্থা হন তারা। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কেউ এলে উনি তাদের আদর করে এই রাজ্যে রেখে দেন।’
এদিন খড়্গপুরে মমতা পাল্টা বলেন, ‘বলে কিনা বাঙালি-অবাঙালি ভাগ করে দাও। আমি কাউকে ভাগ করব না। সবাই আমার ভাই। ভাগ তারাই করে যাদের চোখ-মুখ-কান নেই। কাগজের বাঘ আর রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার।’