নারায়ণগঞ্জের সাতজনকে গুম-হত্যার ঘটনায় হার্ডলাইনে চলে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার পরম্পরা ও সম্ভাব্য দায়ীদের সম্পর্কে জানার পর যেমন র্যাবে থাকা সেনাবাহিনীর তিন জনকে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনি দোষীদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে দিনেদুপুরে এভাবে সাতজনকে অপহরণ করে খুন করা এবং এই খুনের ঘটনার সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও দলের লোক জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় মারাত্মক অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সরকার। নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি দেশের মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক, সমালোচনা ও উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা এবং সর্বপরি সরকারের প্রতি চরম অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করেই সরকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেই কাজ করছে বলে সরকারের এক মন্ত্রী জানান। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে নির্দেশের পর প্রধানমন্ত্রী নিজে এ বিষয়ে সার্বিক খবর রাখছেন। প্রশাসন, দল বা মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যে-ই হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
র্যাবের তিন কর্মকর্তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী গত মঙ্গলবার রাতে তাদের চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন বলে জানা গেছে। নরায়ণগঞ্জের এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত র্যাব-১১ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। ঘটনার পর দিন গত ২৮ এপ্রিল র্যাব-১১ অধিনায়কের পদ থেকে তারেক সাঈদকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হয়।তারপরও তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই তরিঘরি করে র্যাবের ৩জন অফিসারকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা সমেত অবসরে পাঠানোকে তাদের প্রকৃতপক্ষে বাচিয়ে দেবার প্রয়াস মনে করছে দেশবাসী।
সূত্র জানায়, এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ যাতে পার পেয়ে না যায় সে জন্য তিনি বিশেষভাবে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নারায়ণগঞ্জের ঘটনাই নয়, গুম-হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতেও সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনা নিয়ে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন।
বৈঠকে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এক মন্ত্রীর জামাতার জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয় তোলা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন কারো আত্মীয় হোক, জামাতা হোক, দলের লোক হোক, দোষী হলে কাউকেই কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কোনো দিকে তাকানো হবে না। অপরাধীকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতে হবে। এ ঘটনার সঙ্গে দলের কেউ জড়িত হলেও ছাড় পাবে না। টাকা বা অন্য কোনো স্বার্থের বিনিময়ে মানুষ খুন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যতই ক্ষমতাধর হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রী দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি যাতে নষ্ট না হয়, সরকারের কর্মকাণ্ড যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকে লক্ষ রেখেই দোষীরা যাতে পার পেতে না পরে সে জন্য প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্টরা সেভাবে কাজ করছে। দ্রুতই দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। সরকারের অপর এক মন্ত্রী বলেন, সরকার এ ধরনের যে কোনো ঘটনার ব্যাপারে সিরিয়াস।
এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটতে পারে সে জন্য প্রশাসনকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে কোনো ত্রুটি বা গাফিলতি যাতে না হয় এবং এজন্য সরকার প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে দিকে লক্ষ রেখেই কাজ করবে সরকার। গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, প্রবীণ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহরণের পর হত্যার শিকার হন।
গত ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া য়ায়। এই ঘটনার সঙ্গে র্যাবের কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। নজরুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের গুম-হত্যার ঘটনার সঙ্গে সরকারদলীয় নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে এর সঙ্গে জড়িতরা যাতে পার পেয়ে না যায় সে জন্য সরকার শক্ত অবস্থান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।