বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মাস কয়েক আগে র্যাব-১১-এর সেই সিও সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া লেঃ. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদের নেতৃত্বেই অপহরণের পর গুম করা হয় কুমিল্লার লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় এসে তিনি ওই ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই দুই নেতার সঙ্গে অপহরণ হওয়া একজনকে র্যাব সদস্যরা থানা পুলিশের হাতে তুলে দিলেও ওই দুজনের আর হদিস মেলেনি। এ ছাড়া ওই দিনের অভিযানে সাবেক সংসদ সদস্য হিরুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৯ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছিল র্যাব।
অপহৃত হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার দাবি করেন, ‘র্যাবের পোশাক পরা, র্যাবের গাড়িতে করে আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁকে আর ফেরত পাইনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি করুণা ভিক্ষা চাইছি। আমার সন্তানদের কাছে তাদের বাবাকে ফিরিয়ে দিন।’ বুধবার রাতে কুমিল্লার লাকসামে নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শাহনাজ আক্তার এসব অভিযোগ আনেন।
পরে বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও তিনি একই অভিযোগ করেন। সংবাদ সম্মেলনে হুমায়ুন পারভেজের মা রাজিয়া বেগম, ছেলে শাহরিয়ার কবির, মেয়ে মাইমুনা জাহান ঈশিকা, জান্নাতুল নাইম মাইশা, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এস এম তাজুল ইসলাম খোকন ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম উপস্থিত ছিলেন
সংবাদ সম্মেলনে শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘গত বছরের ২৭ নভেম্বর রাতে র্যাব-১১ ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানির ডিএডি শাহজাহান আলীসহ র্যাবের একটি টিম আমার স্বামী হুমায়ুন কবির পারভেজ ও চাচাশ্বশুর সাইফুল ইসলাম হিরুসহ ১২ জনকে তুলে নিয়ে যায়।
ওই সময় সাইফুল ইসলাম হিরুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে র্যাব ১৫ লাখ টাকাও নিয়ে যায়। পরে ১০ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করলেও হুমায়ুন কবির পারভেজ ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুকে ফেরত দেয়নি।
দীর্ঘ পাঁচ মাস ১০ দিন পার হলেও ওই দুজনের সন্ধান আমরা পাইনি।’ তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনার পর র্যাবের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি করতে বলে।
তখন পুলিশ বলেছিল, র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। হুমায়ুন পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার জানান, তাঁর স্বামী, সাইফুল ইসলাম হিরু ও মো. জসিম উদ্দিনকে র্যাবের লোকজন ধরে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়।
তাঁদের শার্ট খুলে তা দিয়েই চোখ বেঁধে ফেলে। পরে তাঁদের পদুয়ারবাজার থেকে ঢাকার দিকে নিয়ে যায়। শাহনাজ আক্তার অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে কেউ র্যাব দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
বক্তব্য জানতে অপহৃত সাইফুল ইসলাম হিরুর স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী পাঁচ মাস ধরে নিখোঁজ। তাঁকে আমরা ফেরত চাই। তাঁর একমাত্র ছেলে রাফসান বলেন, ‘আমার বাবাকে ফেরত চাই।’
উল্লেখ্য, গত বছর ২৭ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে লাকসাম থেকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে হিরু, পৌর বিএনপির সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির পারভেজ এবং একই কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন লাকসাম ফেয়ার হেলথ নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকা যাচ্ছিলেন।
অ্যাম্বুল্যান্সটি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছলে র্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক অ্যাম্বুল্যান্সটির গতিরোধ করে। তারা বিএনপির ওই তিন নেতাকে আটক করে অন্য একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
ওই দিন রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে র্যাব ১১-এর ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানি ২-এর উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) শাহজাহান আলী লাকসাম থানায় মো. জসিম উদ্দিনকে হস্তান্তর করলেও অন্য দুজনের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। কথা হলে নিখোঁজ হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই গোলাম ফারুক বলেন, সে দিন র্যাব ১১-এর সিইও লে. কর্নেল তারেক সাঈদের নেতৃত্বেই অপারেশন হয়েছে। র্যাবের ডিএডি শাহজাহান আলী তাঁদের ধরে নিয়ে যান।
তাঁর ব্যাচ নম্বর ৬০৯২। লাকসামের ওই সময়ের ওসি সব জানেন। গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা এখন মামলা করব। কর্নেল তারেক সাঈদকে প্রধান আসামি করে এবং ডিএডি শাহজাহান আলীসহ এর নেপথ্যে যাঁরা আছেন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করব।’
কারা নেপথ্যে আছেন জানতে চাইলে গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমার ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এর সঙ্গে জড়িত। দলীয় কোন্দলের কারণেও প্রতিপক্ষ ছিল।’ গোলাম ফারুক আরো বলেন, “আমার ভাই ও সাইফুল ইসলাম হিরুকে পেতে আমরা কুমিল্লা র্যাব অফিসে যাই।
সেখানে কুমিল্লার কমান্ডার সাহেব আমাদের তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখে লোক দিয়ে বলান ‘দেখা হবে না।’ আমাদের বলা হয় তাঁরা কাউকে ধরে আনেননি।”
সাইফুল ইসলাম হিরুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার মিল থেকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘র্যাব সদস্যরা আমাদের ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে আলিশ্বর এলাকায় নিয়ে অপেক্ষা করেন। আমাদের চোখ বেঁধে ফেলেন। আমরা বুঝতে পারি কিছুক্ষণ পর পৌর বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিনকে আমাদের গাড়িতে তোলা হয়।
ডিএডি শাহজাহান আলী আমাদের লাকসাম থানায় সোপর্দ করেন। পরে পুলিশ একটি মামলায় আমাদের গ্রেপ্তার দেখায়।” এদিকে মামলা থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।
গত ১৩ মার্চ এক কর্মিসভায় স্থানীয় সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এসব অপহরণ ঘটনার সময় কুমিল্লার লাকসাম থানার ওসি ও বর্তমানে বান্দরবান জেলার পুলিশ লাইনে কর্মরত আবুল খায়েরকে প্রশ্ন করা হয়, মামলা না নিয়ে কেন জিডি করতে বললেন। উত্তরে তিনি বলেন, পারভেজের ভাই গোলাম ফারুক যেভাবে অভিযোগ লিখে এনেছিলেন তাতে তা জিডিই হয়, মামলা হয় না।
র্যাবের নাম উল্লেখ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কি না এ প্রশ্ন এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘ওই সময় র্যাব থেকে কোনো চাপ ছিল না।’
তবে তিনি নিখোঁজ দুজন সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন । এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য র্যাব ১১-এর ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানি ২-এর উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) শাহজাহান আলীর মোবাইলে বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।