দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তা পানিবন্টন চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ভারতের উপর অসন্তুষ্ট বাংলাদেশ। এরইমধ্যে আবার বিজেপি নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশ বিরোধী উসকানিমূলক নানান মন্তব্য বাংলাদেশকে ভারতের প্রতি আরো ক্ষুদ্ধ করে তুলছে। তবে ভোটের মাঠে ভারতের রাজনীতিবিদরা যাই করুক না কেন, বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া আর কোন উপায় তাদের সামনে খোলা নেই বলেই মনে করেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ইন্টারন্যাশানল রিলেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর সিনিয়র ফেলো, লেখক ও প্রবীণ সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক।
সুবীর ভৌমিকের মতে, ভারত তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেই বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য হবে। কারণ ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষায় তার বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বাংলাদেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সুবীর ভৌমিকের মতে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই দিল্লীর ক্ষমতা দখল করুক, তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈদেশিক নীতি ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভাল সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, চীনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তবে এসবের চেয়েও দিল্লী সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা।
নতুন সরকার বড় দেশগুলোর সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে যদি বাংলাদেশের দিকে মনোযোগ না দেয়, তাহলে ভুল করবে বলেই মনে করেন ভারতের বিশিষ্ট এই সাংবাদিক।
ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে ইন্ডিয়ার সাবেক বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব রাজিভ শিকরি বলেন, বাংলাদেশ আকারে ছোট হলেও ভারতের কাছে পাকিস্তান ও চীনের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায়ও বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইন্ডিয়ার বিবাদমান উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো পাকিস্তান ও চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে আসছে। আর এই রাজ্যগুলোকে ভারতের সাথে সংযুক্ত রাখতে বন্ধুর মত সাহায্য করছে বাংলাদেশ।
মুজিব-ইন্দিরার উত্তরাধিকার:
বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরিতে ইন্দিরা গান্ধী যে দিক উন্মোচন করেছিলেন, তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। মনমোহন সিং ভারতের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের পূর্ণ সহযোগিতা পেতে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সফরে করেছিলেন।
মনমোহন সিং’সহ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তা বাধাগ্রস্থ হয়েছে মমতা ব্যানার্জীর কারণে। কলকাতার মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বাধার মুখে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা পানিবন্টন চুক্তি করতে পারেনি। এমনকি মনমোহন সিং ঢাকা সফরকালে সীমান্ত চুক্তি করে ফেলতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি মমতার একগুয়েমীর কারণে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করতে মরিয়া ছিল নিজেদের স্বার্থেই। কারণ বাংলাদেশ, দেশটিতে বাস করা ইন্ডিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করে ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষায় বিশেষ সাহায্য করেছে।
এছাড়া ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র সরবরাহে যুক্ত থাকায় বাংলাদেশের সাবেক দুই মন্ত্রী, দুইজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে চট্টগ্রাম আদালত। একই আদালত উলফার সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়াকেও সাজার আওতায় এনেছে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাকে আরো সুসংহত করেছে।
দিল্লী বান্ধব ঢাকা:
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র আটক হয়। অস্ত্রগুলো আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য চীন থেকে আমদানি করা হয় বলে অভিযোগ আছে। সহযোগিতা করে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি- শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পরেই এই মামলার কার্যক্রম শুরু করে।
বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় যে ধরণের সহযোগিতা করে আসছে, ভারতের উচিত এখন তার প্রতিদান দেওয়া। আর এই প্রতিদান হতে পারে তিস্তা পানিবন্টন চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি করার মাধ্যমে। বিজেপির নেতাদের বাংলাদেশ সংক্রান্ত বক্তব্য ও বাংলাদেশের ভূমি চাওয়ার বিষয়টিও অবৈধ। নরেদ্র মোদীও বাংলাদেশীদের ভারত থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মোদীকে তার বর্তমান অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। এমনকি মোদী হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও বাংলাদেশকে অবহেলার করতে পারবে না। মোদীকেও মনমোহন সিং এর দেখান পথেই চলতে হবে।
ভারত বাংলাদেশের সাথে তিস্তা পানিবন্টন চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি না করতে পারায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী পক্ষ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এরইমধ্যে বিএনপিসহ বাম দলগুলো তিস্তা পানিবন্টন চুক্তির দাবিতে লংমার্চ করেছে। সেখানে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের ২২-২৩ তারিখ তিস্তা ব্যারেজ অভিমুখে লংমার্চের আয়োজন করে বিএনপি। বিএনপি তিস্তা চুক্তিতে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার বিষয়টি সামনে এনে এই লংমার্চের আয়োজন করে। উল্লেখ্য, তিস্তার পানিশূন্যতা বাংলাদেশের কৃষিকাজের ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ ভারতের সাথে সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তি নিয়ে শঙ্কিত। তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে মমতা ব্যানার্জীর কঠোর অবস্থান বাংলাদেশকে চিন্তিত করে তুলেছে। এছাড়া তিস্তা চুক্তি করতে না পারার কারণে আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য দলটির সর্বস্তরের নেতারা মমতাকে দায়ী করছে।
তবে মোদী ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের জন্যই ভাল হবে বলে মনে করেন এই সাংবাদিক। কারণ, মোদীর সাথে মমতা বা আসামের মুর্খমন্ত্রীর রাজনৈতিক জোট না থাকায়, তাদেরকে টপকে মোদী বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরিতে তিস্তা পানিবন্টন ও সীমান্ত চুক্তি করতে পারে। আর মোদী সেটা করতে ব্যর্থ হলে শুধুযে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কই খারাপ হবে এমনটা নয়, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে।
বিজেপি সরকার সবসময়ই বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখতে বদ্ধ পরিকর। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতা গ্রহণের পরে তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির নিরাপত্তা উপদেষ্টা। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাজপেয়ি বিএনপি-জামায়াতকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কারগিল পেতে বাজপেয়ি পাকিস্তানের সাথে যেভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, তেমনি ভারতের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযুক্তি বজায় রাখতেও বাংলাদেশের সাহায্য প্রয়োজন। যদিও বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশ ব্যাপক সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ ভারতের।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, মোদী বা বিজেপির যেই ক্ষমতায় আসুক কেন, তারা এমন কোন ভুল করবে না, যেটা রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলে। ফলে মোদী ভোটের বাজারে বাংলাদেশ বিরোধী কথা বললেও, বাংলাদেশকে কোনভাবেই ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইবে না। বিজেপি ক্ষমতা দখল করলে বাংলাদেশীদের ভারত থেকে বের করে দেওয়া তো দূরের কথা, বরং মোদী তাদের সাদরে বুকে টেনে নেবেন। আর মোদীর এমন আচরণই পারে ভারতের অখন্ডতা ও জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখতে।তবে মোদী বাংলাদেশের জনগনের প্রকৃত প্রতিনিধীত্বকারী সরকারের সাথে কাজ করত বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।