দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ স্বল্প খরচ, উন্নত খাবার, কঠোর নিরাপত্তা, লেখাপড়ার উন্নত পরিবেশ, নারীকে স্বাবলম্বী করতে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ও হোস্টেল- এমন আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন রাস্তার মোড়ে মোড়ে। আর নামগুলোও ‘আস্থা’ তৈরি করতে বেশ কার্যকরী: নিবেদিকা হোস্টেল, ভিআইপি মা হোমস ছাত্রী নিবাস, স্বর্গ ছাত্রী নিবাস, নিরাপদ ছাত্রী হোস্টেল, স্বপ্ননীড় ছাত্রী হোস্টেল, আপনঘর ছাত্রী হোস্টেল ইত্যাদি। রাজধানীর ফার্মগেট, গ্রীনরোড, আজিমপুর, মোহম্মদপুর, নীলক্ষেত এলাকায় গেলে এরকম শত শত পোস্টার ও ব্যান্যার চোখে পড়বে।
প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পড়াশুনা ও চাকরি করতে আসা নারীদের জন্য রাজধানীতে এই হোস্টেল ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে উঠছে। আজিমপুর, লালমাটিয়া, মনিপুরিপাড়া, মগবাজার, ফার্মগেট এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য মহিলা হোস্টেল।
দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজধানী শহরে নারীদের জন্য থাকা-খাওয়া ও নিরাপদে ঘুমানোর একটা ব্যবস্থা হয়েছে বলে আশ্বস্থ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু ভেতরের অবস্থা জানলে এসব হোস্টেলে একেবারে ঠেকায় না পড়লে কেউ থাকতে চাইবেন না। হোস্টেলের নামে এই খুপড়িঘরগুলোতে চলে মালিকদের চরম স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, নিরাপত্তার নামে নিপীড়ন। কোনো নিয়ম-কানুনের পরোয়া করা হয় না এখানে। সহজলভ্য না হওয়া এবং বারবার হোস্টেল বা মেস বদলের ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর সক্ষমতা না থাকার কারণে ছেলেদের মতো মেয়েরা এসবের প্রতিবাদ করার সাহস করে না। আর এই সুযোগটিই নেন মালিকরা।
মহিলা হোস্টেল সবেচেয় বেশি আছে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে। এসব হোস্টেলে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা না থাকলেও ব্যবসায় কিন্তু লাভ করে যাচ্ছেন মালিকরা। ফার্মগেট এলাকার ১১৩, গ্রীনরোড এলাকায় মোস্তফা রোডের গলিতে ঢুকলে একটু পর পর এমন হোস্টেলের দেখা পাওয়া যায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবাসিক ভবন বা ভবনের একটি অংশ ভাড়া নিয়ে হোস্টেল ব্যবসা চলছে। এখানে থাকতে হলে সিট, ফুড, ভর্তি ফি, সার্ভিস চার্জ, আইপিএস, নিরাপত্তা বাবদ ফি দিতে হয়। এসব বাদেও রয়েছে অন্যান্য ফি। আর ফির অংকটাও অস্বাভাবিক বেশি। তারপরও কিন্তু যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে এখানকার হোস্টেলে থাকা ছাত্রী ও কর্মজীবী নারীদের নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হোস্টেল ব্যবসার প্রধান মৌসুম মে থেকে নভেম্বর মাস। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে প্রচুর ছাত্রী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে এসব হোস্টেলে ওঠে। এই সুযোগে মালিকরাও ভাড়া বাড়িয়ে দেন। অনেক হোস্টেলে নিয়মতি ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করা হয়। এই সময়টাতে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদেরকেও জিম্মি করে বেশি ভাড়া ও ফি আদায় করা হয়।
হোস্টেলে থাকেন এমন কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিজ্ঞাপনে যে সিট ভাড়া উল্লেখ থাকে হোস্টেলে ওঠার পর তা বাড়িয়ে দেয়া হয়। নতুনদের কাছ থেকে অস্বাভাবিক ভাড়া আদায় করা হয়। কয়েক মাস পর পরই কোনো নোটিশ ছাড়াই কয়েকশ’ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় পানি নিয়ে। প্রায়ই পানি থাকে না। তখন ছাত্রীদের চরম সমস্যায় মুখে পড়তে হয়।
অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নন্দিতা দাশ নামে নিবেদিকা হোস্টেলের এক ছাত্রী বলেন, ‘এখানে অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা পানি। পানিতে খুব দুর্গন্ধ, খাওয়া যায় না। হোস্টেল কৃর্তপক্ষকে অনেকবার বলেও কোনো লাভ হয়নি। অনেক সময় তিন-চার দিন পর্যন্ত পানি থাকে না। তখন বাথরুম ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।’
নতুনদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি জানা যায় মোহনা হোস্টেলে অবস্থানরত এক ছাত্রীর কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘আমি যে সিটের ভাড়া দেই ৪ হাজার ২৫০ টাকা, পুরনো মেয়েরা ওই একই ধরনের সিটে থাকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে।’
যশোর থেকে পিংকি আক্তারকে খামারবাড়ি এলাকার একটি হোস্টেলে ভর্তি করাতে এসেছেন তার মামা। এককালীন ১৬ হাজার ৫০০ টাকা লাগবে শুনে তো তার মাথায় বাজ পড়েছে। সামনে ভাগনির বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং। এখন উপায় কী!
মামা শফিকুর রহমান দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘টাকার পরিমাণ যে এত বেশি হবে এটা ভাবতেই পারিনি। বিভিন্ন ফি বাবদ হোস্টেল কর্তৃপক্ষ এ টাকা আদায় করছে। কী আর করা ভাগনিকে তো ভর্তি করতেই হবে। তা না হলে সে থাকবে কোথায়?’
অনুসন্ধানে জানা যায়, মে-জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে আসা ছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। সিঙ্গেল ও ডাবল বেড অনুযায়ী সিট ভাড়া আলাদা হয়। ভর্তি ফি বাবদও টাকা আদায় করা হয় যা অফেরতযোগ্য। হোস্টেল মালিকরা মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়কে বলেন ব্যবসার মৌসুম। এসময়টাতে হোস্টেল ভাড়া ও অন্যান্য ফিও নেয়া হয় অনেক বেশি। নিচের চিত্রটা দেখলে ধারণা পাওয়া যাবে-
ইউসিসি কোচিং সেন্টার পরিচালিত ভিআইপি মা হোমস ছাত্রী নিবাস (১১৩, গ্রীনরোড, ফার্মগেট) ভর্তি কোচিং করতে আসা ছাত্রীদের কাছ থেকে একাকলীন নিচ্ছে ১৬ হাজার ৭০০ টাকা, মাসিক ৭ হাজার ৫০০ টাকা (ভাড়া ও অন্যান্য ফি) করে দিতে হবে। মোহনা হোস্টেল (১১৯, মোস্তফা রোড, ফার্মগেট) এককালীন ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং মাসিক ফি রাখে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা।
নিবেদিকা হোস্টেল (গ্রীনরোড়, ফার্মগেট) এককালীন ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং মাসিক ভাড়া ও অন্যান্য ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। এছাড়া গোধূলী, শ্রাবন্তী, সাদিয়াসহ ফার্মগেটের প্রত্যেকটি হোস্টেলে নতুন ছাত্রীদের কাছ থেকে এরকম লাগামছাড়া টাকা নিচ্ছে। এছাড়া চাকরিজীবীদের কাছ থেকে নেয়া হয় আলাদা ফি।
মৌসুম ছাড়া অন্য সময় এই এককালীন টাকা ফেরতযোগ্য। তবে এ টাকা নিয়েও অনিয়ম করে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। হোস্টেল ছেড়ে দেয়ার সময় নানা অজুহাতে (হাড়ি-পাতিল-প্লেট-বাটি ব্যবহার, বৈদ্যুতিক বাল্ব নষ্ট হওয়া, চুলা ইত্যাদি) দুই তিন হাজার টাকা রেখে দেয়।
হোস্টেলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, আট থেকে ১০ কক্ষের একটি হোস্টেল বানানো হয়েছে চার কক্ষের একটি ফ্ল্যাট হার্ডবোর্ড দিয়ে ভাগ করে। বারান্দা, ব্যালকুনি, ডাইনিং এমকি রান্নাঘর পর্যন্ত ভাড়া দেয়া হয়েছে। একটি কক্ষে তিন জন থাকাই কষ্টকর সেখানে উঠানো হয়েছে ৭ থেকে ১০ জন। একটি বাথরুম ১০ থেকে ১২ জনকে শেয়ার করতে হয়। ফলে জরুরি অবস্থায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় মেয়েদের।
বেশ কয়েকটি হোস্টেলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ভাড়া ও ফি নিচ্ছে ইউসিসি কোচিং সেন্টার পরিচালিত ‘মা হোমস ছাত্রী নিবাস’।
ছাত্রীদের অভিযোগ ও বেশি টাকা নেয়ার কারণ জানতে চাইলে মা হোমসের পরিচালক মোস্তাফ কামাল বলেন, ‘মে থেকে নভেম্বর মাস হোস্টেল ব্যবসার মৌসুম। বছরের বাকি সময় অফসিজন থাকে তাই এই সময়টা আমরা বেশি টাকা নিই। সারা বছরের ঘাটতিটা পুষিয়ে নেয়া হয়। নভেম্বরের পর থেকে আমরা কম নিয়ে থাকি।’ তবে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনো অনিময় হয় না। এখানে ছাত্রীদের রাখা হয় শুধু। তাদের পড়াশুনার সর্ব্বোচ সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়।’
পানির সমস্যা নিয়ে ছাত্রীদের অভিযোগ থাকলেও নিবেদিকা হোস্টেল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের এখানে পানির কোনো সমস্যা নেই। তারা ফিল্টারের পানি সরবরাহ করেন। তবে কেউ অভিযোগ করে থাকলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
যারা শুধু বেহিসাবি মুনাফার জন্য ব্যবসা করেন তারা অনিয়মের অভিযোগের পাত্তা দেবেন না এটাই স্বাভাবিক। হোস্টেলগুলোতে অনিয়ম চলে, ঢাকায় পড়তে আসা মেয়েরা এবং কর্মজীবী নারীরা চরম ভোগান্তি নিয়েও বাধ্য হয়ে এসব হোস্টেলে থাকেন- এটাই চরম বাস্তবতা। সরকারি হোস্টেলে আবাসন সঙ্কট, নোংরা পরিবেশ- আর এই সুযোগে অলিতে গলিতে গড়ে ওঠা মহিলা হোস্টেলে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। মহিলা হোস্টেলগুলোর প্রতি সরকার এখনই নজর না দিলে মুনাফালোভী মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা আরো চরমে উঠবে। সরকার নারী প্রগতির কথা বলছে, নারী ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মহলকে গলা ফাটিয়ে জানান দিচ্ছে কিন্তু নারীদের এই স্বচেষ্ট প্রগতি ও ক্ষমতায়ন অর্জনের পেছনের যন্ত্রণার কথা জানছে না বা জানার চেষ্টা করছে না।