দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ বলা হয়ে থাকে , বিদেশে শ্রমবাজার নষ্টে বাংলাদেশী শ্রমিকদের চেয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা বেশি দায়ী। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টার কারণে ক্রমেই কমে আসছে বাংলাদেশের শ্রমিক রপ্তানির বাজারের আওতা।
এছাড়া প্রবাসে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব থাকলেও দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিজেরাই শ্রমিকদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের কাজে লিপ্ত রয়েছে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সর্বশেষ ইরান থেকে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফেরা শ্রমিকরা পাচারকারীদের সাথে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছেন। এমনকি মন্ত্রণালয় নিজে উদ্যোগ নিয়ে আটক বাংলাদেশীদের উদ্ধারের চেষ্টা করলেও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার অভিযোগও তুলেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ইরানে বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের এহেন অপরাধ প্রবণতা বিদেশের শ্রম বাজারের বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে ক্ষতি করছে বলেই মনে করছে প্রবাসী শ্রমিক পরিবার ও শ্রমিক কল্যাণে সংশ্লিষ্টরা।
ধারণা করা হয়, ইরাক, ইরান, তুরষ্ক, লিবিয়া, গ্রীসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জেলে ৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশী আটক আছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মতে, এই সংখ্যাটি কয়েকগুণ বেশি হবে। আর এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সঠিক কোন তথ্যও নেই। সরকারের মন্ত্রণালয়কে প্রতিমূহুর্তে এই বিষয়ে দূতাবাসগুলোর তথ্য দেওয়ার কথা থাকলেও, দূতাবাসগুলো তা করছে না। বরং নিজেরাই জড়িয়ে যাচ্ছে নানান বিতর্কে।
সর্বশেষ ইরান থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশীকে। মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের উদ্ধারে চেষ্টা করলেও ইরান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা কারণে আটককৃতদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার পায় শ্রমিকরা।
উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের অভিযোগ, দূতাবাস কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলা ও পাচাররোধে করনীয় নিয়ে দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের সাথে কথা বলেছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম(সিসুক)’-এর নির্বাহী পরিচালক সাকিউল মিল্লাত মোরসেদ।
ইরানের কারাগারে আটক বাংলাদেশীদের বিষয়ে সিসুকের সংবাদ সম্মেলনের পরে সংগঠনটির সাথে যোগাযোগ করে ইরানে আটক থাকা শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে। শ্রমিকদের উদ্ধারে আন্তরিক মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে জানতে ইরান দূতাবাসকে চিঠি লেখে। নিয়ম অনুসারে কোন দেশে বাংলাদেশীরা আটক থাকলে, সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে। তারপর মন্ত্রণালয় আটক বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে।
মন্ত্রণালয় বার বার চিঠি দেওয়ার পরেও দূতাবাস মন্ত্রণালয়ের চিঠির কোন জবাব দেয়নি। পরে মুক্তিপণ দিয়ে আটক বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। আটক থাকা শ্রমিকরা বাংলাদেশে ফিরে এসেই অভিযোগ তোলেন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দিকে। তাদের দাবি, ইরান দূতাবাসের কর্মকর্তারা আটককারীদের সাথে যুক্ত।
ইরান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের অভিযোগ নিয়ে নতুনদিনের সাথে আলোচনায় সিসুকের নির্বাহী পরিচালক সাকিউল মিল্লাত মোরসেদ, মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব না দিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নীরব থাকাকে রহস্যজনক আখ্যা দেন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা কেন নীরব ছিলেন, তারও উত্তর জানা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই উন্নয়ন কর্মকর্তা।
দূতাবাসের কর্মকর্তারা ঠিক মত দায়িত্ব পালন করলে এই ধরণের সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রথমত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, কোন দেশে কতজন বাংলাদেশী আছে, তাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি কী, কতজন অবৈধভাবে আটক আছে, তাদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া কী, তা প্রতিমাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা।
দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো সে রকম কোন কাজই করে না। বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়গুলোতে কোন দেশে কত জন বাংলাদেশী বাস করে, তাদের পরিস্থিতি কি, কতজন আটক আছে, তার কোন তথ্যই নেই। কারণ দূতাবাসগুলো কখনই এই বিষয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে না।
প্রবাসীদের ফাঁদ থেকে মুক্ত রাখার উপায় সম্পর্কে তিনি আমাদের জানান ,পাচারের এই ফাঁদ থেকে বাংলাদেশীদের অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। আমাদের শ্রম বাজারকে রক্ষা করতেই, পাচার বন্ধে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ নতুন কোন বাজারে শ্রমিক পাঠাতে পারছে না। বন্ধ হওয়ার পথে আরো কিছু শ্রম বাজার। সে অবস্থায় অবৈধভাবে পাচার ও আটকে রেখে মুক্তিপণের ঘটনা চলমান বাজারগুলোতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। এমনকি শ্রম বাজারগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ফলে শ্রমবাজার রক্ষার জন্য হলেও সরকারের উচিত পাচাররোধ ও প্রবাসীদের সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া। দেশের বাইরে কাজ করতে যাওয়া প্রবাসীদের কাউন্সিলিং করানর ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তারা বুঝতে পারে, কোন ব্যক্তি সৎ আর কোন ব্যক্তি অসৎ। এছাড়া তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেখার বিষয়েও দূতাবাসকে সক্রিয় হতে হবে। এই সমস্যা হয়ত একদিনে সমাধান করা যাবে না, কিন্তু দূতাবাসগুলো সক্রিয় হলে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
পাচারকারীদের আটক ও শাস্তির বিষয়ে এই উন্নয়ন কর্মকর্তা জানান, পাচার কাজের সাথে যুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা গেলে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান সম্ভব। অসাধু ব্যক্তি, যারা এমন কাজের কাজের সাথে যুক্ত থাকে, অশিক্ষিত মানুষদের লোভে ফেলে বিদেশে পাচার করছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি ও বড় অংকের আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা করতে পারলে, এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে।
এছাড়া ফিরে আসা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদান সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা এই ধরণের পাচারের শিকার হয়ে বিদেশে গিয়ে নির্যাতন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তাদেরকে এমন অংকের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত যাতে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসে। বিদেশ থেকে কোন নারী প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসলে তাকে মাত্র ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তাও আবার সকল অভিযোগ, নির্যাতিত হয়েছে তার প্রমাণ দিতে পারলে। যেটা অমানবিকই নয় অপরাধও বটে। কারণ, একজন নির্যাতিতা নারীর মানসিক ও শারীরীক দূর্ভোগের কথা চিন্তা না করে কেবল আর্থিক দিকটা চিন্তা করা উচিত না।
একইভাবে ফিরে আসা ব্যক্তিদের প্রতি সৎ ও ইতিবাচক মানসিকতার বড় অভাব রয়েছে। এমনকি খোদ সরকারের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিদেশ থেকে বিলিয়ন ডলার পাঠান ব্যক্তিদের প্রতি নেতিবাচক মানসিকতা ধারণ করে। সম্প্রতি হংকং থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসে বেশকয়েক জন নারী শ্রমিক। তারা মন্ত্রণালয়ে তাদের কষ্টের কথা জানান ও ক্ষতিপূরণের নামে প্রহসনের প্রতিবাদ করেন। এই সময় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাদের সাথে খুবই বাজে ব্যবহার করে।
পাচাররোধে বায়রার ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশীদের পাচারের বিষয়টিকে বায়রা সবসময়ই এড়িয়ে যায়। কিন্তু বায়রাকে এড়িয়ে না গিয়ে এই বিষয়ে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। সংগঠন হিসেবে বায়রা কোনভাবেই খারাপ না, কিন্তু মনে রাখতে হবে বায়রার সাথে যুক্ত সবাই সাধু না। বায়রার অনেক সদস্য মানব পাচারের সাথে যুক্ত থাকতে পারে। সরকার ও বায়রার উচিত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। একইভাবে বায়রার উচিত, যে সব রিক্রুটিং এজেন্সীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
বায়রা যদি শ্রমিক পাচাররোধে সোচ্চার হয়, তাহলে পাচারের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু বায়রার নীরবতা এই অপরাধকে দিনকে দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেই মনে করেন সাকিউল মিল্লাত মোরসেদ।