দৈনিক প্রথম বাংলাদেশঃ শুন্য ‘স্বপ্নের হেরেমখানা’, বাসাবাড়ি ছেড়ে গেছেন ভাড়াটিয়ারা, বালুর মাঠে পড়ে আছে এবিএস পরিবহনের ৩২ বাস। খাঁ খাঁ করছে সিদ্ধিরগঞ্জ ক্ষমতার দাপটে অবৈধভাবে গড়ে তোলা এরশাদ শিকদারখ্যাত নূর হোসেনের সাম্রাজ্য। প্রকাশ্যে নেই অস্ত্রের ঝনঝনানি, অনেকটা বন্ধ সন্ত্রাস, মারপিট, দখলদারিত্ব। নেই ভিভিআইপি স্টাইলে রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো গাড়িবহর।
অনেকটাই ‘নিষ্প্রাণ’ পড়ে আছে হালের জমিদারের দখল করা বাসাবাড়ি, খামার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন এখন পলাতক। দুই দশকেরও কম সময়ে ট্রাক হেলপার থেকে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই কাউন্সিলর এখন অঢেল সম্পদের মালিক। ক্ষমতার অপব্যবহার আর দখল স্বত্বেও হাতিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি জমি-প্লট-বাড়ি। অথচ নূর হোসেন স্বাক্ষরিত (২০১১ সালের ২ অক্টোবর) কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য দেয়া হলফনামায় মত্স্য ব্যবসায়ী হিসেবে তার বাত্সরিক আয় মাত্র ১৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ।
সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্যানেল মেয়র নজরুলসহ ৭ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে সিদ্ধিরগঞ্জের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ওরফে হোসেন চেয়ারম্যানের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
যদিও এখনও ক্রোক হয়নি নূরের মালিকানাধীন শিমরাইলের এবিএস পরিবহনের লাক্সারি ৩২টি বাস। বাসগুলো সারিবদ্ধভাবে তার বাড়ির পাশে বালুর মাঠে গ্যারেজে রাখা হয়েছে। শূন্য পড়ে আছে নূরের ‘স্বপ্নের হেরেমখানা’।
ভাড়াটিয়ারা ফ্ল্যাট ছাড়ায় ফাঁকা হয়ে গেছে অ্যাপার্টমেন্ট। খামারে মাছ চাষ থাকলেও মাছ ধরার বাহিনী নেই। তার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজ বাহিনীর অনেকেই আত্মগোপনে। নূরের যতো বাড়ি-ফ্ল্যাট: সংশ্লিষ্টরা জানান, অবৈধ দখল আর নামমাত্র ক্রয় দেখিয়ে অঢেল সম্পদ করেছেন নূর হোসেন।
এরমধ্যে রয়েছে ৫টি বিলাসবহুল বাড়ি ও ৪টি ফ্ল্যাট। শিমরাইল মৌজায় ৩৭৩নং দাগে প্রায় ১১ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যায়ে ৫ তলা ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন নূর হোসেন। এই ফ্ল্যাটের উপরের দুইতলায় করেছেন অত্যাধুনিক বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স। এই বাড়িটিতে ব্যবহার করেছেন ইটালি থেকে আমদানি করা ব্রাউন কালার থাই গ্লাস। স্যানিটারি পণ্য দিয়েছেন ইটালি ও ভারতের। টাইলস এবং মার্বেল দিয়েছেন চীন ও নেপালের। ঝাড়বাতি দিয়েছেন জার্মানি থেকে আমদানি করা।
স্বপ্নের এই ‘হেরেমখানায়’ এ মাসেই পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করার পরিকল্পনা ছিল নূর হোসেনের। অভিযোগ আছে— এই জমির প্রকৃত মালিক নাজির উদ্দিনের ছেলে আশাব উদ্দিন। আশাবকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে মাত্র ২০ লাখ টাকায় নূর কিনেছেন এ জমি। শিমরাইল মৌজায় ৭২ ও ৭৩ নম্বর দাগে ১০ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্প্রতি ৬ তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন নূর হোসেন। এ বাড়িতেও সংযোজন করেছেন জার্মান, চীন, ভারত ও নেপাল থেকে আমদানি করা স্যানিটারি সামগ্রী, টালইসসহ অত্যাধুনিক সব আসবাবপত্র।
দুই ইউনিটের এ বাড়িটির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া থাকলেও সম্প্রতি খুন ও মামলার কারণে ভাড়াটিয়ারা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছেন। অভিযোগ আছে— এই জমির প্রকৃত মালিক লাল মিয়ার ছেলে আদম আলী। আদম আলীকেও মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে মাত্র ১৭ লাখ টাকায় নূর হোসেন কিনেছেন এ জমি।
শিমরাইল মৌজায় ৩১২ নম্বর দাগে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৬ তলা ভবন তৈরি করছেন নূর হোসেন। কুমিল্লার এক বাসিন্দার জমি জোরপূর্বক দখল ও রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বাড়ি করছেন সিদ্ধিগঞ্জের এই ত্রাস। রসুলবাগে সাড়ে ৮ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা ভবন নির্মাণ করছেন নূর হোসেন। এই জমির অর্ধেকই সরকারি। আর অর্ধেকের মালিক আদমজী জুট মিলের এক কর্মকর্তা। সিদ্ধিরগঞ্জ মৌজায় ১০ শতাংশ জমির ওপর ৭ তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ভবনটিতে সরকারি রাস্তা দখল করে নির্মাণ হচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন। নূর হোসেনের মালিকানায় রাজধানীর গুলশান-২-এ রয়েছে ২টি ফ্ল্যাট। গুলশান লেকের অপজিটে ৩৬০০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট দুটিতে বসবাস করতেন নূর হোসেন।
এছাড়া বনানী ও ধানমণ্ডিতে আরও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজনদের দাবি— ৪টি ফ্ল্যাটের গড় মূল্য অন্তত ৮ কোটি টাকা। জমিদার নূর হোসেন: সংশ্লিষ্টদের দাবি— অন্তত ৫০ বিঘা জমির মালিক নূর হোসেন, যার অধিকাংশই হয়েছে দখল আর ক্ষমতার অপব্যবহারে। এরমধ্যে রয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ আঁটি মৌজায় ২ বিঘা জমি।
শফর আলীর মালিকাধীন এ জমি জোরপূর্বক দখল করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ক্রয়সূত্রে মালিক বনে গেছেন নূর হোসেন। তবে পরে ২ কোটি টাকা মূল্যের এ জমির বিপরীতে ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ আঁটি মৌজায় ৪২৮ দাগে প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ৩০ শতাংশ জমি মাত্র ১০ লাখ টাকায় কিনেছেন নূর হোসেন। আমিজউদ্দিন চেয়ারম্যানের ছেলে হাবিব হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে বিপর্যস্ত এই পরিবারকে জিম্মি করে ও ভয় দেখিয়ে পানির দরে এ সম্পদের মালিক হন নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিংয়ের উল্টো পাশে ৪ বিঘা সরকারি জমি দখল নিয়েছেন নূর হোসেন।
এ জমির মালিকানার দাবিতে টাঙানো সাইনবোর্ড সম্প্রতি ভেঙে দিয়েছে এলাকাবাসী। সম্প্রতি সানারপাড় এলাকায় ৪ বিঘা জমি কিনেছেন নূর হোসেন। নিমাই কাসারী এলাকায় মর্তুজা আলী স্যারের স্ত্রী জাহানারার কাছ থেকে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকায় এ জমি কিনেন তিনি। এখনও মূল্যবাবদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পাওনা আছে জাহানারার। এছাড়া কয়েকদিন আগে মুক্তিনগরে ৩ কোটি টাকায় কিনেছেন ১৫ কাঠা জমি। নূর হোসেনের শিমরাইলের বাড়ির পিছনে প্রায় ৪০ বিঘা জমি নিয়ে রয়েছে মত্স্য খামার। এই খামারের মালিকদের বঞ্চিত করে নূর তার সহযোগী সুকশি এলাকার ‘মাছ মনিরকে’ দিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চাষ করে আসছেন।
এই খামারের মধ্যে পানির ওপরে গড়ে তোলা টংঘরে বসে নানা ধরনের অপকর্মের ফাঁদ এঁটেছেন নূর ও তার বাহিনী। এছাড়া নূরের নির্দেশে ডিএনডি বাঁধও আটকে মাছ চাষ করে আসছেন ‘মাছ মনির’। অথচ ডিএনডি বাঁধে মাছ চাষের জন্য বরাদ্দ পায় মারিয়া ট্রেডার্স। অভিযোগ আছে— নূর হোসেনের সব ধরনের দখল করা জমির রেজিস্ট্রেশন করেছেন বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির কেন্দ্রীয় সচিব ও নারায়ণগঞ্জ জেলার দলিল লেখক সমিতির সহসভাপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান হাবিব। গত দুদিন তার কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলে বলেন, ‘কয়েকটি জমির রেজিস্ট্রেশন আমি করেছি।
এ সময় অনিয়মও দেখেছি; কিন্তু নূর হোসেনের ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করিনি।’ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অবৈধ জমিরও বৈধ মালিকানা দিয়েছেন— এমন প্রশ্নে কোনো সদুত্তর দেননি এই দলিল লেখক। দখলের থাবায় মসজিদও: নূরের দখল থেকে বাদ পড়েনি আল্লাহর ঘর মসজিদও। নূরের ব্যবসার প্রয়োজনে প্রায় ১০০ বছরের পুরনো মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন নূর হোসেন। পরে পাশে রাস্তার ধারে টিনেঘেরা মসজিদ বানিয়ে দেন। আর মসজিদের জায়গায় মাছের আড়ত তৈরি করেন, যেখানে চলে এলাকার মাছ বিক্রি।
এই আড়ত থেকে দিনে অন্তত ২৫ হাজার টাকা কমিশন পেতেন নূর হোসেন। মসজিদ উচ্ছেদের সময় এলাকার অনেকেই বলেছেন, ‘এই দুঃসাহসিকতার কারণে নূর একদিন জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।’ ব্যবসায় মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ: বাড়ি-ফ্ল্যাট-জমির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায় মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন নূর হোসেন।
সম্প্রতি ৮ কোটি টাকায় বানিয়েছেন ৪টি বাল্কগেট (বালু কাটার মেশিন)। ডেমরা এলাকায় আফজালের ডগে (একেকটি ১৮০০ স্কয়া ফুট) তৈরির প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এসব বাল্কগেট। এসব বাল্কগেট তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন হীরাঝিলের বাল্কগেট ব্যবসায়ী মতিন ওরফে কালো মতিন। বালু উত্তোলনের প্রয়োজনে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় পাইপ কিনছে নূর হোসেন। এরইমধ্যে এ টাকা ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বলকে দিয়েছেন নূর। এছাড়া তার সহযোগীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের অর্থ লগ্নি করেছেন নূর হোসেন।
বালুমাঠে এবিএস বাস: নূর হোসেনের মালিকানাধীন ৩২টি এবিএস (আহাদ, বিপ্লব ও সিনথিয়া) বাস গত ১ মে থেকে বন্ধ হয়ে আছে বালুমাঠে। এসব গাড়ি তদারকিতে নেই কোনো ড্রাইভার-হেলপার-কন্ডাকটর। নূর হোসেনের সন্তানদের নামের এসব পরিবহন নারায়ণগঞ্জ টু চিটাগাং রোডে চলাচল করলেও এখন বন্ধ। আর নসিব পরিবহনের কাউন্টার দখল করে নেয়া এবিএস গাড়ির কাউন্টারও বন্ধ। পালিয়ে রয়েছে পরিবহন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার আশাব উদ্দিনও।
এসব গাড়ি অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে পড়লেও এবং নূরের বাড়ি থেকে মাত্র ১ মিনিট দূরত্বের পথ হলেও তা ক্রোক করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুই দশকেই সাম্রাজ্যের মালিক: সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮৫ সালের ট্রাক হেলপার নূর হোসেন ১৯৮৭ সালে ট্রাক ড্রাইভার। ১৯৯১ সালে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। ২০১২ সালে কাউন্সিলর। ২০১৪ সালে শতকোটি টাকার মালিক। খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল, জুয়া, মাদকসহ অসামাজিক কার্যকলাপ আর ক্ষমতার অপব্যবহারে বিপুল এই বিত্তবৈভব। নূরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী এলাকায় ছিল ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’।
শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জসহ অধিকাংশ এলাকার অঘোষিত ‘মালিক’ নূর হোসেন। তার নির্দেশই এখানে ছিল আইন। টাকা ছাড়া সবকিছুই এখানে অচল। ফলে এই এলাকায় ফ্রি স্টাইলে সংঘটিত হয় সব ধরনের অপরাধ। চাঁদার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হলেও ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, পরিবহন ও শিল্প মালিকরা নিশ্চুপ থেকেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহারে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার, বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনের ঘটনাও ঘটেছে অহরহ।
এমনকি প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকা আয়ের টার্গেটে ‘মহা ক্ষমতাধর’ নূর বাহিনী অবৈধ সব কাজই করেছে এলাকায়। এতে স্থানীয়রা অতিষ্ঠ-ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদ করার সাহস দেখায়নি। যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের প্রায় সবাই নির্যাতনে জখম-পঙ্গু হয়ে প্রাণনাশের ভয়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে। অভিযোগ আছে— সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো এতোসব লঙ্কাকাণ্ড দীর্ঘদিন ঘটলেও ‘অভিযোগ-মামলা হয় না’ বুলি উড়িয়ে গা বাঁচিয়ে চলছেন অবৈধ সুবিধা পাওয়া প্রশাসনের কর্তারা। অবৈধ সুবিধা দেয়ায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ‘দুর্বলতা’র সুযোগ নিয়েছেন নূর হোসেন।