লগি-বইঠা দিয়ে মানুষ পিটিয়ে হত্যা, কুপিয়ে নিরীহ যুবক হত্যা, পেট্রোল বোমায় সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মাড়া এই আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এর পেছনে যে বা যারাই থাকুন না কেন কাজগুলি সম্পাদনের মহান দায়িত্বটি এসে বর্তায় ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত কতিপয় ছাত্র নেতাদের ঘারে। তারা আবার তাদের সহকর্মীদের সহযোগিতায় অর্পিত দায়িত্ব সোৎসাহে সুচারুরূপেই সম্পাদন করে থাকেন।
বিনিময়ে পদ-পদবী, অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা সবই মিলছে। কেবল মাত্র যা মিলছে না, তা হল প্রকৃত শিক্ষা। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যেন পণ করে বসে আছেন, এ দেশে নতুন করে আর কোন প্রকৃত ছাত্রনেতা তৈরি হতে দেবেন না। আর তাই গত তেইশ বছরে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের মত ছাত্র নেতা তৈরির আঁতুড়ঘরেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে দিচ্ছেন না।
যিনি যতই যুক্তি দেখান না কেন; যার বা যাদের ঘারেই দোষ চাপান না কেন; মোদ্দা কথা হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না বা হতে দেয়া হচ্ছে না। শুধু যেঁ নির্বাচন হচ্ছে না তা তো নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই সুস্থ-প্রতিদ্বন্দিতাপুর্ন রাজনৈতিক পরিবেশটুকু পর্যন্ত নেই। সেখানে এখন চলছে চর দখলের ন্যায় দখলের মহোৎসব।
যার ফলে আমরা আরেক জন তোফায়েল আহমদ, সর্ব জনাব শাহ মোয়াজ্জেম, কাজী জাফর, শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান, এনায়েতুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো বা আশির দশকের বাবলু, অভি,ইলিয়াস আলি, রতন বা আমানুল্লাহ আমানদের মত ছাত্র নেতা পাচ্ছি না। যারা ক্ষমতা রাখেন ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেয়ার। পালটে দিতে সক্ষম হন গতানুগতিক ধারা। যাদের হাত ধরে একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়। যাদের অপরিসীম ত্যাগ আর দৃঢ়তার কাছে মুখ থুবরে পরতে বাধ্য হয় পরাক্রমশালী স্বৈরাচার। ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত যে সব ছাত্রনেতা তাদের ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে পরবর্তী জীবনে জাতীর প্রতিটি ক্রান্তি লগ্নে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন, জাতীয় রাজনীতিতে তারাই আজো আলো ছড়াচ্ছেন।
কিন্তু কতদিন? এরা তোঁ আর কেউ অমর নন। সময়ের অমোঘ নিয়মে আজ যারা বর্তমান তাদেরও একদিন পূর্বসূরিদের পথ ধরে চলে যেতে হবে। দায়িত্ব দিয়ে যাবেন কাদের কাছে? তা কি তারা ভেবে দেখেছেন? নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হতে না দিয়ে প্রকারান্তরে তারা আজ জাতিকেই নেতা শূন্য করার ভয়ংকর এক খেলায় মেতেছেন।
অথচ একজন শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে তৎকালীন ছাত্র নেতাদের ভুমিকা ছিল যেমন অনস্বিকার্য; ঠিক তেমনি আজো যে নেত্রিদ্বয়ের হাতে এ দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত তাঁদের এই শক্তির একটি বড় অংশের যোগানদাতা নব্বই পুর্ববর্তী ছাত্র নেতারাই। অথচ আগামীর নেতৃত্ব যাদের উপরে বর্তাবে তারা আশে পাশে এমন কোন সুহৃদই পাবেন না। যা তাঁদের দ্বায়িত্ব পালনকে সহজ করে তুলতে পারে। অতএব এটা বলাই যাই তাঁদের জন্য আসছে সময়টা অনেক বেশি কঠিন। আজ যখন ছাত্র রাজনীতির নামে পেশীশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলা হয় তখন ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলির উদাহরণ টেনে আনা হয়। অথচ সেই ছাত্র নেতা যে আজ আর তৈরি হতে দেয়া হচ্ছে না
। ছাত্রদের হাতে যে এখন কলমের পরিবর্তে অস্ত্র তুলে দেয়া হচ্ছে সে কথা তারা বলছেন না। অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়েই সাধারণ মানুষ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবী তুলছেন। তারা দেখতে পাচ্ছে মেধাবী সুবোধ ছেলেটি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে। নেতৃবৃন্দের এই ভয়ঙ্কর আত্ম বিনাশী খেলায় একদিকে জাতী নেতৃত্বশূন্য হচ্ছে অন্যদিকে মেধাবী ছেলেগুলো দেশের সম্পদ না হয়ে, হয়ে উঠছে সমাজ তথা দেশ বিরোধী শক্তি। এ তো গেল ছাত্র রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নষ্ট ছাত্রদের কথা।
এর বাইরে ছাত্রদের যে বিশাল একটি সংখ্যা রয়েছে। যারা শত প্রতিকূলতা স্বত্বেও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হচ্ছেন তারাই বা কি শিখছেন? বলা হয় পারিপার্শ্বিকতাই মানুষকে তৈরি করে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতরা হয় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নিরাপদ এবং জৌলুশ পূর্ণ জীবন যাপনের মোহে। দেশপ্রেম সেখানে সামান্যতম বাধা হয়ে দাড়াতে পারছে না। কারণ তারা বেড়েই উঠেছে আত্মমগ্ন থেকে। দেশপ্রেমের পাঠটি, তারা না পরিবার না সমাজ না বিদ্যাপীঠ কোথাও থেকেই লাভ করেন নি। আর যারা যে কোন উপায়েই হোক; কোন না কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন তারা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পরছেন।
তাঁদের চাকুরী প্রাপ্তিটাই ছিল অনৈতিক পথে। অবস্থাটা এমন যে, তুমি যোগ্য-মেধাবী ঠিক আছে তোমার জন্য অর্থের পরিমাণটা একটু কম হবে। কিন্তু তুমি যদি ভাব শুধুমাত্র মেধা আর যোগ্যতা দিয়েই চাকরীটা পেয়ে যাবে তাহলে তুমি নির্বোধ! যা তোমার অযোগ্যতাই প্রমাণ করে। এই অনৈতিক পথে চাকুরীর সংস্থান করে সে যেঁ আরও বড় দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক। এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে শুরু করে প্রশাসন। যিনি যেখানেই অধিষ্ঠিত হন না কেন, প্রত্যেকেই নির্লজ্জ দলবাজে পরিণত হচ্ছেন।
তারা জানেন উপরে উঠতে সিঁড়ি লাগবে। আর সে সিঁড়িটা হল রাজনীতিবিদ তথা নেতাদের নোট বুকে ঠাই করে নেয়া। এটা করতে গিয়ে তারা নির্দ্বিধায় নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছেন। জাতীয় ইতিহাসকে পর্যন্ত পাল্টে ফেলছেন। জাতীর বিবেক সেজে প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে অবলীলায় বিভ্রান্ত করে চলেছেন। বিনিময়ে পাচ্ছেন পৃষ্ঠপোষকতা। আর সেটা যেঁ কতটা পাচ্ছেন তা তাদের বৈধ আয়ের সাথে জীবন যাপনের তুলনামূলক চিত্রই বলে দেয়। ভোগ বাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় এদেরকে সঠিক পথে কে আনবেন?
একটি জাতীর বিবেক যদি এভাবে পচে যেতে শুরু করে তার ধ্বংস ঠেকানোর উপায় কি? জাতীর বিবেক কে জাগ্রত করার দায়িত্ব যাদের। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন যাদের মুল কর্তব্য রাষ্ট্রের সেই অভিভাবকদের তো বোধোদয় হতে হবে। অভিভাবক যদি হন নীতি ভ্রষ্ট, তার কি নৈতিক ক্ষমতা থাকে অন্যকে শোধরানোর? এ জাতির আজ যারা অভিভাবকত্ব করছেন তারা পরিশুদ্ধ নন। তাদের হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। নির্যাতিতের অভিশাপ তাদের রেখেছে অন্ধ করে। ভয়ঙ্কর শেষ পরিণতির অপেক্ষায় এক একজন! তবে আমাদের ভয়টা সেখানে নয়, ভয়টা হল তাদের অবর্তমানে বিভ্রান্ত এ জাতী সঠিক পথে এগুতে পারবে তো? যে জঞ্জাল আজ স্ব প্রণোদিত হয়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে তার হাত থেকে সহজে মুক্তি মিলবে তো? আগামীর দেশ গড়ার কারিগরদের আজ যেভাবে অর্থ লোলুপ, ভোগবাদী, নৃশংস করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা চলছে তাতে তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ ছাড়া আর তো কিছু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নিছক ছাত্র লীগের একজন কর্মী হওয়াই যদি হয় যোগ্যতার সনদপত্র তাহলে, ছাত্র লীগের যে কর্মী বা নেতা দলের হয়ে বিরোধী পক্ষকে কচুকাটা করতে সক্ষম হবে তার যোগ্যতার মাপকাঠিটি কি হতে পারে? ঠিক একই ভাবে ছাত্র দল বা ছাত্র শিবিরের কর্মী হওয়া যোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি বলেই হয়ত কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র একই ভাবধারার মানুষের চাকুরী হয়। এই যে প্রলোভন; বেঁচে থাকার তাগিদে কজনের পক্ষে সম্ভব একে উপেক্ষা করা? আজ আমরা সামান্য লিফটে ওঠার বিতণ্ডায় ইন্টার্র্নি ডাক্তারদের দেখি রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাতে।
দেখি দাবী আদায়ের অস্ত্র হিসেবে সাধারণ রোগীদের জিম্মি করার মত অমানবিক আচরণ করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখি দাবী আদায়ের নামে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিতে। সাধারণ ছাত্ররা যখন করজোড়ে মিনতি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে তখনও তাদের মানবিকতা জেগে ওঠে না। এরাই আর কিই বা শেখাবেন তাদের শিক্ষার্থীদের? পাঠক, এখন আপনার সন্তানকে মানুষ বানাবেন না অর্থ তৈরির যন্ত্র বানাবেন সেটা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। আমরা আজ যা শেখাচ্ছি তা হয়ত একজন চিকিৎসক তৈরিতে সক্ষম। তবে সেবক যে নয় সেটা নিশ্চিত। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার পরিবেশ সনদ ধারী শিক্ষিত করে তুলতে পারলেও তা যে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে পারছে না তা তো সমাজের সর্বস্তরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এড়াই তো একদিন এ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।
ভেবে দেখুন তো স্বার্থান্ধ, অমানবিক, অর্থ গৃধ্নু কিছু মানুষের হাতে দেশ। নেতৃত্বশূন্য একটি জাতী! পরিস্থিতিটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে! আজ যারা সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় অংশগ্রহণ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তারা কেন ছাত্র রাজনীতির এই রুগ্নতা নিয়ে অতটা উচ্চকিত নন তা তারাই ভাল জানেন। এখনো তো তাও ষাট,শত্তুর, আশির দশকের কিছু ছাত্র নেতা বেঁচে আছেন বলেই রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করা হয়। তাদের অবর্তমানে তো সে সুযোগটিই আর থাকছে না; কারণ নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা তো হচ্ছেই না, সৃষ্টি হওয়ার সুযোগটি পর্যন্ত রাখা হচ্ছে না। এটা যদি হয় উত্তরসূরিদের পথ নিষ্কণ্টক করার অপপ্রয়াস।
তাহলে বলব অযোগ্য উত্তরসূরিদের জাতীর ঘারে বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার এই চেষ্টা তাঁদের পথকে কুসামাস্তির্ন করতে সক্ষম তো হবেই না বরং তাদের সাথে সাথে দেশকেও এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। আমাদের আজকের নেতৃবৃন্দের এটা অন্তত বোঝা উচিৎ, চাইলেই নেতা বানানো যায় না। নেতা হয়ে উঠতে হয়। আর সে জন্য প্রয়োজন স্বকীয়তা-যোগ্যতা। যা সব সময় উত্তরাধিকার সূত্রে মেলে না। যদি মিলেও যায় সে ক্ষেত্রেও প্রতিদ্বন্দিতাপুর্ন পরিবেশের মধ্য থেকেই তাকে শানিত করে নিতে হয়।