বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং কাজী নজরুল ইসলাম এক ও অবিভাজ্য সত্তা। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির আজ ১১৫তম জন্মবার্ষিকী।তার এই জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে নানা অনুষ্ঠান। তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। নজরুল ইসলাম আজো কোথাও স্রেফ ইসলামের কবি আবার কারো কাছে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিরূপ।কিন্তু নজরুল তার কবিসত্তায় ভর করে অনেক আগেই সকল শিরোনামের সীমানা পাড়ি দিয়েছেন। তাই নজরুলকে স্রেফ কতগুলো শব্দে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। বর্তমান সময়ের নজরুল ভাবনা ও এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নজরুল ইসলামের নাতনি সঙ্গীত শিল্পী খিলখিল কাজীর একান্ত সাক্ষাৎকার:
একটা কথা খুব শোনা যায়, জাতীয় কবি হিসেবে নজরুল অবহেলিত। নজরুল কি সত্যিই অবহেলিত? নজরুল পরিবারের সদস্য হিসেবে বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
আমি বলবো, কথাটা পুরোপুরি সত্য না হলেও কিছুটা তো সত্য অবশ্যই। নজরুল এ দেশের জাতীয় কবি কিন্তু জাতীয় কবির যে মর্যদা তা নজরুল পুরোমাত্রায় পায় না। দেখা যায়, নজরুলের জন্মবার্ষিকী আর মৃত্যুবার্ষিকী ঘিরে কিছু অনুষ্ঠান হয় প্রতিবছর। এ সময়টাতে শুরু হয় শিল্পীদের ছোটাছুটি। বছরের বাকি দিনগুলোতে নজরুলকে নিয়ে আর কিছু হয় না।
আমি নজরুল পরিবারের সদস্য ঠিকই কিন্তু আমি বলবো সমগ্র বাংলাদেশের মানুষই নজরুল পরিবারের সদস্য। অথচ নজরুলের নামে নেই কোনো ওয়েবসাইট। নজরুলকে নিয়ে পূর্নাঙ্গ একটা ওয়েবসাইট খুবই জরুরি। একটা দেশের জাতীয় কবির নামে এই আধুনিক যুগে ওয়েবসাইট থাকবে না তা হতে পারে না। জেলায় জেলায় পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে নজরুল কর্ণার করা উচিৎ। এতে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা গণমানুষের ভেতর আরো বিস্তৃত হবে।
সরকারিভাবে নজরুলের জন্মবার্ষিকী নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়। নজরুলকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে নজরুল ইনস্টিটিউট…
সরকার আর কতটা পারে! সরকারের বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে তাকে নিয়ে আরো কাজ হওয়া প্রয়োজন। সরকারি কাজ সব সময়ই অপ্রতুল। কারো চেতনায় তো আর সরকার নজরুলকে জোর করে স্থাপন করতে পারবে না। আমি বিভিন্ন সময় ভারতীয় টিভিতে দেখেছি সেখানে তাদের চলচ্চিত্র এবং নাটকে রবীন্দ্রনাথের নানা বাণী এবং কথা থাকে। হয়ত দেখা যাবে একটা ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে নায়ক-নায়িকা এরই এক ফাঁকে দেখানো হবে দেয়ালে ঝুলে আছে রবীন্দ্রনাথ। এটা আমাদের দেশের নাটক-চলচ্চিত্রে করা যেতে পারে। এটা করা উচিৎও। এভাবেই তো চেতনার ভেতর নজরুলকে প্রতিস্থাপন করতে হবে।
নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কী?
নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে আমি কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা যদি নজরুল চর্চা করতে চাই, তাহলে নজরুল চর্চা করতে পারবো। কথা হচ্ছে, নজরুলকে আমরা নজরুল হিসেবে ব্যবহার করতে চাই, নাকি চাই না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে নজরুলের উপস্থিতি খুব বেশি নেই। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের বেশিরভাগই সরকারি কর্মকর্তার মতো আচরণ করেন। বাংলা বিভাগে নজরুল গবেষণা তেমন নেই বললেই চলে।
বাংলাভাষী কবিদের মধ্যে এবং বাঙালি মুসলমানদের মধ্যেও প্রথম বহুমাত্রিক চলচ্চিত্রকার কাজী নজরুল ইসলাম। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি নেই বললেই চলে। অথচ বিভিন্ন সময় তার গল্প-উপন্যাস থেকে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
দেখুন, এটা সত্য যে, তার গল্প উপন্যাস থেকে বিভিন্ন সময় নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য সেসব নির্মাতারা আমাদের কোনো ধরণের অনুমতি নেয়নি। নজরুলের গানও ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু এর জন্য আমরা কোনো রয়্যালিটি পাই না। একবার শুধু চ্যানেল আই থেকে একটা ফিল্মের অনুমতি নিয়েছিল। মেহেরনিগার নামে ওই চলচ্চিত্রটিতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত নজরুলের গল্পের সঠিক ব্যবহার হয়নি। তারা কাটাছেড়া করে নজরুলের গল্পের বিকৃতি ঘটিয়েছে। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদও নজলের গান ব্যবহার করেছেন তার কাজে কিন্তু তিনিও আমাদের থেকে কোনো অনুমতি নেননি।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। ফোন কোম্পানীগুলো ওয়েলকাম টিউনে নজরুলের গান নিয়ে বাণিজ্য করছে দীর্ঘদিন। এসব কোম্পানীগুলো রয়্যালিটি দেয়?
না। এরা আমাদের কোনো ধরণের রয়্যালিটি দেয় না। নজরুলের গান নিয়ে এরা কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমার এদের থেকে এক পয়সাও পাই না। শুনেছি, এক রামজান মাসেই নজরুলের ইসলামি সংগীত ওয়েলকাম টিউন করে এরা কয়েকশ কোটি টাকা অবৈধ আয় করে। এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। আমরা এসবের কোনো অনুমতি দেইনি।
নজরুল সংগীতের সুর বিকৃত নিয়ে বলুন…
এখন সুর বিকৃত হওয়ার সুযোগ কম। নজরুল ইনিস্টিটিউট থেকে স্বরলিপি প্রকাশ হয়েছে। আগে সুর বিকৃতির অবকাশ ছিলো। কথা হলো, নজরুল নিজে ভীষণ আধুনিক ছিলেন। তার গান রিমিক্স হোক, এটা খারাপ না। শুধু সুর বিকৃত না করে আর কথা ঠিক রেখে সবই হতে পারে। ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যাপারেও এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে।
এ বছর কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে'নজরুল ও অসাম্প্রদায়িকতা’ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন।
নজরুল ছিলেন সকল ধর্মের উর্দ্ধে ওঠা মানবতার ধারক এবং বাহক। বাংলাদেশে নজরুলের প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি। এখনও এখানে ধর্মীয় বিদ্বেষ দেখা যায়। যা নজরুল চিরতরে নির্মল করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ তিনি দূর করতে আজীবন চেষ্টা করেছেন। নজরুলের গান-কবিতা ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এবং ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। পরিশেষে বলবো, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মৌলবাদ বিরোধী চরিত্রের গুণে তিনি হয়েছেন সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ কারিগর।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছিলেন তিনি নজরুল একাডেমি গঠন করবেন। তিনি কি তার কথা রেখেছেন?
মমতাকে ধন্যবাদ তিনি তার কথা রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন নজরুল তীর্থও। তবে পশ্চিমবঙ্গে নজরুলকে নানাভাবে হেয় এবং ছোট করে দেখা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে আপনার কোনো চাওয়া আছে?
আমার একটা শেষ চাওয়া আছে। নজরুলের নামে এদেশে খুব বেশি কিছু নেই। আমি চাই নজরুলের নামে একটা বড় কিছু হোক। সেটা সেতু হলে ভালো হয়। দাদু পদ্মা নদী নিয়ে বেশ কিছু গান লিখেছিলেন। আমি প্রস্তাব করবো নজরুলকে সম্মান জানিয়ে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি যেনো তার নামে হয়। এর বাইরে আর কিছু চাইবো না। নজরুলের চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে। সবার মঙ্গল কামনা করছি।