দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সেভেন মার্ডারের ঘটনায় এমপি শামীম ওসমানের ‘সম্ভাব্য’ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিষয়ে ইউটার্ন নিয়েছেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান।
মঙ্গলবার রাজধানীতে তিনি সংবাদ সম্মেলনে লিখিতভাবে দাবি করেছেন, ‘শামীম ওসমান সেভেন মার্ডারের সঙ্গে জড়িত নন। বরং যারা শামীম ওসমান ও নূর হোসেনের কথোপকথন রেকর্ড করেছেন, তারাই জড়িত।’ অথচ সোমবার শহীদ চেয়ারম্যান নিজেই অভিযোগ করেছিলেন, হত্যাকাণ্ডের পর নূরের সঙ্গে শামীম ওসমানের টেলিকথোপকথনই প্রমাণ করে তাদের মধ্যে সখ্য ছিল। আর ভারতে পালিয়ে যেতে নূর হোসেনকে সহায়তা করেছেন এ অভিযোগ এখন অনেকটা সত্য।
এদিকে নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের বিচার নিয়ে আইনজীবীরা প্রকাশ্যে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হওয়ায় তদন্ত কাজের অগ্রগতি নিয়েও মারাত্মক সংশয় দেখা দিয়েছে। অপরদিকে নূর হোসেনের বাস থেকে গতকাল অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণণগঞ্জে অপহরণের পর খুন হওয়া সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম দাবি করেছেন, সাত খুনের ঘটনায় শামীম ওসমানের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে তিনি মনে করেন না। বরং একটি গোষ্ঠী শামীম ওসমানকে জড়িয়ে নোংরা রাজনীতি করছে।
তার দাবি, ‘শামীম ওসমান ও নূর হোসেনের ফোনালাপের রেকর্ড যারা প্রকাশ করেছেন, তারাই এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। তিনি এই প্রশ্নও তোলেন ‘তারা যদি জানেন নূর হোসেন ওই সময় কোথায় কোথায় ছিলেন, তাহলে কেন গ্রেপ্তার করলেন না?
শহীদুল ইসলাম বলেন, আরও কিছু ফোনালাপ ও বক্তব্যের রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছে। মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর ঘনিষ্ঠ ও ঠিকাদার আবু সুফিয়ান, ব্যবসায়ী চাঁন মিয়া, খুনি হিসেবে পরিচিত সেলিম, নূর হোসেনের বডিগার্ড হাসানের ফোনালাপও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে তো কথা হচ্ছে না? তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এখনও কেন আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? তাহলে এরাই কি ছিল মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের জোগানদাতা? তাদের কি ওই গোষ্ঠী রক্ষার চেষ্টা করছে?’
নিহত নজরুলের শ্বশুরের দাবি, ‘গত ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত নূর হোসেনের সঙ্গে অনেকবারই শামীম ওসমান কথা বলেছেন। এসব কথাবার্তায় প্রমাণ হয় না শামীম ওসমান নূর হোসেনকে পালাতে সহায়তা করেছেন। বরং প্রমাণিত হয়, যারা রেকর্ডটি প্রকাশ করেছেন, তারাই তাকে পালাতে সহায়তা করেছেন।’
তবে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়া শেষে শহীদুল ইসলামকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন থেকে দ্রুত চলে যান।
এদিকে আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারের ঘটনার প্রধান আসামি নূর হোসেনের মালিকানাধীন একটি বাস থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় গুলিভর্তি অস্ত্র, কার্তুজ ও ছোরা উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে ওই সময়ে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা যায়নি। এ ঘটনায় নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আলাউদ্দিন জানান, সোমবার রাত পৌনে একটায় সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়া এলাকাতে থাকা হোসেনের মালিকানাধীন এবিএস পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-৩৭৬০) থেকে ২ রাউন্ড গুলিসহ ৩টি রিভলবার, একটি পিস্তল, শটগানের ৫ রাউন্ড কার্তুজ ও কিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে বাসের অজ্ঞাত চালক ও নূর হোসেনকে আসামি করে অস্ত্র আইনে মামলা করেছেন। এছাড়া বাসটি জব্দ করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৫ মে আদালতের নির্দেশে সিদ্ধিরগঞ্জে নূর হোসেনের বাড়ি থেকে অস্থাবর সম্পত্তি থেকে মালামাল ক্রোকের সময়ে ৮ রাউন্ড গুলিসহ একটি রিভলবার, শটগানের ৮ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরও আগে উদ্ধার করা হয়েছিল বিপুল সংখ্যক ফেনসিডিল বোতল।
তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সংশয় : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আরও জানান, জেলার আদালতের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সেভেন মার্ডারের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ জেলার আইনজীবীরা এখন শুধু বিভক্তই নন, তারা এখন একে অপরকে প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদের নেতারা আইনজীবী সমিতির নেতাদের উল্লেখ করে বলেন, একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের অপরাজনীতির প্রেসক্রিপশনে প্রভাবিত হয়ে তারা উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে মামলার তদন্তের পিঠে ছুরি দিতে চাইছেন। তারা জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। তারা নূর হোসেনকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন।
জবাবে আইনজীবী সমিতির নেতারা বলছেন, সম্মিলিত আইনজীবী সমিতির নেতারা খুনিদের দালাল হিসেবে মাঠে নেমেছেন। তবে উভয়পক্ষই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা পুলিশ সুপারকে ব্যর্থ বলে দাবি করছেন।
দুপুর ১২টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা জজ আদালতের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে সম্মিলিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপুর সভাপতিত্বে মানববন্ধন চলাকালে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ‘প্রজন্ম ৭১’-এর ব্যানারে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর আগে সকাল ১১টায় তারা নারায়ণগঞ্জ আদালতের সামনের রাস্তায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রুটে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
পরে তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের মানববন্ধনে যোগ দেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী সংগঠনের নেতা এবং প্রজন্ম ’৭১-এর ব্যানারে উপস্থিত সবাই এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। সম্মিলিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন চলাকালীন সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিচার দাবি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে জেলা আইনজীবী সমিতির মানববন্ধন চলাকালে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে অ্যাডভোকেট আওলাদ হোসেন বলেন,নূর হোসেনের রক্ষিতা নীলার মামলা করে নূর হোসনে বিচার চাওয়া যায় না। প্রশাসনের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তদন্তকাজ শেষ করুন। ইন্টারপোলের নামে নাটক সাজালে চলবে না। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, এক মাস অতিবাহিত হলেও ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ তদন্তকারী সংস্থা ও সরকার। ইন্টারপোলের বিষয়টি সত্য নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছু জানে না। অডিও প্রকাশ হওয়ার পর শামীম ওসমানের করা সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যই প্রমাণ করে ঘটনার সঙ্গে র্যাবের পাশাপাশি শামীম ওসমানও জড়িত।
পলাতক অনেক কাউন্সিলর : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সেভেন মার্ডারের ঘটনার পর থেকে সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন দুজন কাউন্সিলর, মার গেছে একজন আর একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের
একজন কাউন্সিলর। আর তাদের অনুপস্থিতির কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষ।
নূরের রোষানলে পড়ে ৩ মামলার আসামি রতন : নূর হোসেনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত জুয়া, অশ্লীল নৃত্য ও অপকর্মের ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে তথ্য অধিকার আইনে জানতে চেয়ে চরম মাসুল দিতে হয়েছিল এক ব্যক্তিকে। ওই সময়ে প্রশাসন এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করে। এর পিছনে ওই সময়কার এসপি নূরুল ইসলামের হস্তক্ষেপ ছিল।
সোমবার নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউসে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির শুনানি চলাকালে কমিটির কাছে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন করে এসব তথ্য জানান শহরের মাসদাইর এলাকার ভুক্তভোগী আলী আহাম্মেদ রতন। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকার একটি মার্কেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে আলী আহাম্মেদ রতন বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ট্রাক স্ট্যান্ডে জুয়া, যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য হওয়ায় বিষয়টি জানতে তিনি গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ওই সময়ে ডিসি মনোজ কান্তি বড়াল ও এসপি সৈয়দ নূরুল ইসলামকে তথ্য অধিকার আইনে একটি লিখিত চিঠি দেন। একমাস পর ৩ অক্টোবর রতনকে প্রেরিত জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার তাসনিম জেবিন বিনতে শেখ স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন চলমান রয়েছে।
রতন অভিযোগ করেন, নূর হোসেনের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে অবহিত করায় তার ওপর ক্ষিপ্ত হয় প্রশাসন। কারণ এ অপকর্মের পিছনে ডিসি ও এসপি জড়িত ছিল। এ কারণে রতনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়।