দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ অধিকাংশ এমপি শুল্কমুক্ত সুবিধায় টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার স্টেশন ওয়াগন ভিএক্স আমদানি করতে চান। বিশেষ সুবিধা পাওয়ায় ৭ কোটি টাকার ল্যান্ডক্রুজার তারা মাত্র ৭৬ লাখ টাকায় আমদানি করতে পারবেন। সংসদ থেকে গাড়ি আমদানি সংক্রান্ত চিঠি পাওয়ার পরই এমপিরা আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এবার নির্বাচিত হয়েছেন এমন এমপির সবাই যদি এই ধরনের গাড়ি আনেন আর তা যদি ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায় আমদানি হতো তাহলে সরকারের রাজস্বপ্রাপ্তি হতো প্রায় ৯শ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এমপিরা পাঁচ বছর পর পর শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির সুযোগ পান। এই সুবিধা নিতে এ পর্যন্ত ৪০ জনের মতো এমপি নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে সংসদের সেবা শাখায় জমা দিয়েছেন। এদের অধিকাংশের পছন্দ ল্যান্ডক্রুজার ও মিতশুবিসি পাজেরো। তবে ল্যান্ডক্রুজারের চেয়ে কম দামের গাড়ির জন্যও আবেদন করেছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, বিধান অনুযায়ী তারা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনতে পারেন। কিন্তু বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি না করা ভালো। কারণ সরকারি টাকা অপচয়ে এমপিরা সতর্ক হবে এটিই সবার প্রত্যাশা।
জানা গেছে, ঝিনাইদহ-২ থেকে নির্বাচিত তাহজীব আলম সিদ্দিকী ৪৫০০ সিসির টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার আনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও এ সুবিধায় ল্যান্ডক্রুজার ও প্রাডো গাড়ি আমদানি করতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের হাবিবে মিল্লাত (সিরাজগঞ্জ-২), মীর মোস্তাক আহমেদ রবি (সাতক্ষীরা-২), দিদারুল আলম (চট্টগ্রাম-৪), আনোয়ারুল আবেদীন খান (ময়মনসিংহ-৯), একেএম শাহজাহান কামাল (লক্ষ্মীপুর-৪), সংরক্ষিত মহিলা আসনের বেগম শিরিন নাঈম, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ (ঢাকা-৬), ইয়াহিয়া চৌধুরী (সিলেট-২), এম এ মান্নান (ময়মনসিংহ-৭) প্রমুখ। এছাড়া অনেক এমপি ল্যান্ডক্রুজার ও প্রাডো গাড়ি আনার জন্য ফরম সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে। জামালপুর-৪ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির মামুনুর রশীদ জানান, তিনি গাড়ি আমদানির জন্য ফরম পূরণ করেছেন। তিনি টয়োটা প্রাডো গাড়ি আনবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ করে দেয়ায় সরকার বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। জনপ্রতিনিধিদের এ ধরনের সুবিধা নেয়া অনৈতিক। তাই এই সুবিধা বন্ধ করা উচিত।
গাড়ি আনার ফরমে ২-এর (ঘ) শর্ত অনুযায়ী এমপিদের প্রত্যয়ন করতে হয় যে, তারা বিলাসবহুল লেক্সাস, মার্সিডিস বেঞ্জ, হ্যামার, বিএমডব্লিউ, পোর্সে, ফেরারি, ক্যাডিলাক, রোলস রয়েস, রেঞ্জ রোভার ইত্যাদি গাড়ি আনতে পারবেন না। সংসদের এক কর্মকর্তা জানান, নতুন নির্বাচিত অনেক এমপি তাদের কাছে পরামর্শ চাচ্ছেন কীভাবে ঐসব গাড়ি আনা যেতে পারে। এ তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অনেক এমপি। এছাড়া নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এবার নিবন্ধন পাওয়া বিএনএফের এক এমপিও রয়েছেন।
সংসদের একটি সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী একবার গাড়ি আমদানির পর পাঁচ বছরের মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনতে পারবেন না তারা। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করার সময় চারটি পৃথক হলফনামায় পাঁচ বছরের আগে অন্য কারো কাছে গাড়ি হস্তান্তর না করার অঙ্গীকার করতে হয়। পাঁচ বছর পর গাড়ি বিক্রি করলে অব্যাহতিপ্রাপ্ত কাস্টমস ডিউটি, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক গাড়ি হস্তান্তরের আগেই সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কমিশনারের কাছে পরিশোধ করার বিধান রয়েছে।
নবম জাতীয় সংসদে প্রথম দিকে হ্যামার, রোলস রয়েস, বিএমডব্লিউ, পোরসে, মার্সিডিজ বেঞ্জ, জাগুয়ার, করভেট, লেক্সাসের মতো ১৩টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি ঠেকাতে গাড়ির ধরন ও সিসি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় ৩ হাজার সিসির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে এমপিদের চাপে গাড়ির ধরন ও সিসি পরিবর্তন করা হয়। এখন যে কোনো সিসির গাড়ি আমদানি করতে পারবেন তারা।
নবম জাতীয় সংসদের ৩৫০ এমপির মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ৩১৫ জন গাড়ি আমদানি করেছিলেন। এর মধ্যে ২শর বেশি এমপি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার, প্রাডো, মিতশুবিসি, পাজেরোর মতো বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেন। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকার ওপরে। তবে পাঁচ বছরের বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রথমে ১৫০ জন এমপি গাড়ি আমদানির সুযোগ পাবেন। এতে সরকারের ক্ষতি হবে প্রায় ৫শ কোটি টাকা। এছাড়া পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর গত সংসদও গাড়ি এনেছিলেন এমন এমপিরাও গাড়ি আনতে পারবেন।
এতে এ সরকারের আমলেও হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে। কারণ নবম সংসদের শেষ দিকে শহিদুজ্জামান সরকারের এক লিখিত প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদ সদস্যদের নাম ও গাড়ির মডেল, শুল্কায়িত মূল্য ও শুল্ক করাদির পরিমাণের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। সেই প্রশ্নোত্তর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুল্কমুক্ত সুবিধায় সবচেয়ে বেশি মূল্যের গাড়ি কিনেছেন সরকারদলীয় এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি ৭৯ লাখ ২২ হাজার ৬৩৯ টাকা দামে ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি কিনে শুল্ক সুবিধা পেয়েছেন ৬ কোটি ৬৬ লাখ ৫৪ হাজার ১১৩ টাকা। কর সুবিধা না পেলে তাকে এ গাড়ি ৭ কোটি ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার ৭৪২ টাকায় কিনতে হতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ বলেন, নিয়ম অনুযায়ীই সবাইকে গাড়ি আনতে হবে। তবে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি না করাই ভালো। আমাদের মতো গরিব দেশে এধরনের গাড়ি ব্যবহার অনৈতিক বলে আমি মনে করি।
সূত্র জানায়, শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা দিতে ২৯ মার্চ সংসদের সেবা শাখা থেকে এমপিদের কাছে চিঠি দেয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর পরই গাড়ি আমদানির জন্য সংসদে যোগাযোগ শুরু করছেন তারা। কেউ কেউ সেবা শাখা থেকে ফরম নিয়ে তা পূরণ করছেন। ওই ফরম অনুযায়ী এমপিদের জানাতে হয় তারা কত সিসির কোন ধরনের গাড়ি আমদানি করতে চান। এছাড়া এর আনুমানিক মূল্য কত হতে পারে তাও উল্লেখ করতে হয়। গাড়িটি আমদানি করতে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন আছে কিনা তাও জানাতে হয়।