থাইল্যান্ডের সামরিক শাসন জারির দীর্ঘদিন আগেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতিপর্ব। এ পর্বে থাকে দ্বন্দ্ব, সংঘাত আর গোলকধাঁধা। এই পর্ব চলাকালে অজানা রহস্যচক্রে আটকা পড়ে কোন দ্বন্দ্বেরই সমাধান হয় না, কোন সংঘাতই থামান যায় না। আর, রাজনীতির গোলক ধাঁধায় ঘুরে ঘুরে নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের।
রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে চলতে থাকে একের পর এক দুর্ঘটনা। তখন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীদের সেনাশাসন কামনা করা ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে ত্রাতার মতো উপস্থিত হয় সেনা শাসকরা। তাতে, সেনা শাসকদের বৈধ না হলেও অবৈধ বলার কোন সুযোগ থাকে না।
কিন্তু সেনা শাসন জারির পেছনে থেকে যায় রহস্যাবৃত কৌশল ও কারণ। এই রহস্য একেক সময় একেক দিকে মোড় নিতে পারে।
থাইল্যান্ডের প্রায় একশ বছরের ইতিহাস বলে, সেনা শাসন সামরিকবাহিনীর রাজত্ব কায়েমের জন্য নয়, কোন রাজনৈতিক দলকে সহায়তা করার জন্যও হতে পারে। বিরোধের মুখে ক্ষমতাসীন দল আর টিকে থাকার পথ না পেলে ক্ষমতা দিয়ে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। তখন সেনাবাহিনী কোন একটি রাজনৈতিক দলের জন্য আগে গিয়ে পথ পরিষ্কার করে রাখবে এমনটাই প্রত্যাশা করা হয়।
পথ পরিষ্কার করা মানেই, সেনা শাসনের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া। নিঁখুত সফলতার সাথে সেনাবাহিনী এই দায়িত্ব পালন করে। তখন সহজেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। শান্ত পরিস্থিতিতে আবারও নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে পূর্বের ক্ষমতাসীন দল।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি থাইল্যান্ডের সেনাশাসন এই রূপটিরই একটি উদাহরণ। কেননা, নানান দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে অভিযোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি ইংলাক সিনাওয়াত্রা। অপরদিকে, বিরোধী দলগুলো মাসের পর মাস ধরে সমানতালে রাজনৈতিক প্রতিরোধ করে আসছিল।
ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে পদচ্যুত হওয়ার আগে ছয়মাস টানা আন্দোলন করে বিরোধী দলগুলো। এছাড়া, সাংবিধানিক বিধি-বিধানকে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার স্বার্থে অপব্যবহারের অভিযোগগুলো ছিলই। অবশেষে, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সিনাওয়াত্রাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এমন সময়েই ইংলাককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যখন তার পদচ্যুতির পর দেশেটির নেতৃত্ব দিয়ে সমস্যা সমাধানের প্রস্তুতি ছিল না বিরোধী দলগুলোর। ফলে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যাতে সেনাবাহিনীই ক্ষমতা নেওয়ার একমাত্র বিকল্পে পরিণত হয়। এখন দেশটির সেনাবাহিনী বলছে, তারা নির্বাচন কেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের গ্রহণযোগ্য উপায় বের করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেশ শাসনের ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
২০১৪ সালের এই সেনা অভ্যুত্থানকে ২০০৬ সালের সামরিক শাসনের কার্বনকপি বলা হচ্ছে। ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার সেনাশাসন থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলকে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। একারণেই, ২০০৬ সালে সেনাবাহিনী সিনাওয়াত্রার পদাতিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়েছিল বলে সমালোচিত হয়। মূলত,সে সময়ের সেনাশাসনের কারণেই থাকসিন সিনাওয়াত্রা সহস্রাধিক মানুষকে বিনাবিচারে হত্যার অভিযোগে বিচার হওয়া থেকে পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।
সেনাবাহিনীর সহায়তাতেই খুন-দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ সত্ত্বেও তার বোন ইংলাক আবারও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। একারণেই, সন্দেহ করা হচ্ছে যে, বর্তমান সেনাঅভ্যুত্থানও ইংলাককে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রক্ষা করতেই করান হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত আবারও ফিরে আসতে যাচ্ছে ‘দুঃশাসনের’ একই চক্র।
আবার, একেবারে ভিন্ন ঘটনাও ঘটতে পারে। সেনাবাহিনী নিছক ক্ষমতার লোভে, পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দলের যোগসাজোশ ছাড়া, ক্ষমতা দখল করে ফেলতে পারে। নিজস্ব নীতিতে এগিয়ে বদলে দিতে পারে পুরো ইতিহাসের গতিপথ।