টানা দুদিন গোলাগুলির পর বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত এখন পুরোপুরি শান্ত। তবে আতঙ্ক কমেনি। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে দুই দেশই সীমান্তে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার করেছে। মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি সীমান্ত রক্ষী সদস্য। মায়ানমার তাদের সীমান্তে সম্প্রতি সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মায়ানমারে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। গোলাগুলির ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় নিহত বিজিবি নায়েক মিজানুর রহমানের লাশ ফেরত দিয়েছে মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ)।
তবে মিজানুরের সঙ্গে থাকা একটি এসএমজি (স্মল মেশিন গান) ও ১২০ রাউন্ড গুলি ফেরত পাওয়া যায়নি। আগামী ৩ জুন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রগোলাবারুদগুলো ফেরত দেয়ার কথা রয়েছে। আগামী ১০ জুন মায়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে বিজিবি ও মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ইতিপূর্বেও বহুবার বৈঠক হয়েছে।
তবে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়নি। মায়ানমারের আন্তরিকতার অভাব ও ভাষা সম্পর্ক উন্নয়নে বড় বাধা। শনিবার ঢাকার পিলখানা বিজিবি সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ এসব তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, গত ২৮ মে বুধবার রাতে কক্সবাজারের নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়নের পাইনছড়ির ৫২ নম্বর পিলারের কাছে মায়ানমার সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে টহল দিচ্ছিল বিজিবি সদস্যরা। এ সময় আচমকা মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি বিজিবির ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় নিখোঁজ হয় নায়েক মিজানুর রহমান নামে এক বিজিবি সদস্য।
ঘটনাস্থলে একটি রক্তমাখা মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। রক্তের প্রবহমান দিক দেখে বোঝা যায় মিজানুর রহমানকে মায়ানমারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুরু হয় বিজিপির সঙ্গে যোগাযোগ। বৃহস্পতিবার বিজিপির পক্ষ থেকে বিজিবিকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ৫২ নম্বর পিলারের কাছে যেতে বলা হয়।
সেখানে গেলে আবারও গুলি করে বিজিপি। বিজিবিও গুলি করে। পরে বিজিপি মর্টার শেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় বিজিবির ৪ জন সদস্য পাহাড় থেকে ছড়ার নিচে পড়ে যান। ওই রাতেই দুজন উদ্ধার হয়। গত শুক্রবার অন্য দুজনও জীবিত ফেরত আসেন। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ির ইউনিয়নের পাইনছড়ির ৫২ থেকে ৫৪ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি স্থানে বিজিবির কাছে একটি মরদেহ নিয়ে আসার কথা ছিল। ওই মরদেহ বিজিবির নিখোঁজ নায়েকের বলে নিশ্চিত ছিল বিজিবি।
বিজিবি সদস্যরা কফিন নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে থাকে। এ সময় বিজিপি মরদেহ না এনে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বিকাল আড়াইটার দিকে বিজিপি বিজিবির ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চালাতে থাকে। এমন ঘটনায় বাংলাদেশস্থ ঢাকায় নিযুক্ত মায়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ হয়।
শেষ পর্যন্ত বিজিপির সঙ্গে যোগাযোগ হয়। যোগাযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার অতিরিক্ত পরিচালক মেজর তারেকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি বিজিবি দলকে বিজিপি মায়ানমার সীমান্তের জিরো লাইন অতিক্রম করে নিয়ে যায়। সেখানে মিজানুর রহমানের লাশ শনাক্ত করা হয়। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় হস্তান্তর করে বিজিপি।
তিনি বলেন, মিজানুর রহমানের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। তবে মিজানের সঙ্গে থাকা একটি অস্ত্রগোলাবারুদের হদিস মেলেনি। আগামী ৩ জুন বিজিবি-বিজিপির মধ্যে কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে অস্ত্রগোলাবারুদ ফেরত পাওয়ার কথা রয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক আরও বলেন, বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
এর অন্যতম কারণ বিজিপির অনাগ্রহ ও ভাষাগত সমস্যা। বাংলাদেশের সঙ্গে বিজিপির সম্পর্ক উন্নয়ন করার আগ্রহ লক্ষ করা যায়নি। মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভিযোগ, বাংলাদেশে আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারেটি অর্গানাইজেশন) নামের সংগঠন রয়েছে। সংগঠনের সদস্যরা মায়ানমারে আচমকা প্রবেশ করে দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি করে। জাতিগত দাঙ্গায় এসব অর্গানাইজেশনের সদস্যরা জড়িত।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেই তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে আশ্রয় নেয়। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, আমরা বহুবার সীমান্ত বৈঠকে মায়ানমারকে বলেছি, বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। যদি থাকত তাহলে তাদের সম্পর্কে যেন বিজিবিকে তথ্য দেয়। রীতিমতো তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিন্ত তারা কোনো তথ্য দিতে রাজি নয়। বাংলাদেশে এ ধরনের অর্গানাইজেশন থাকলে আমরা তার বিরুদ্ধে অভিযান চালাব।
তাদের কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় করে দেব। কিন্তু আজও মায়ানমারের তরফ থেকে এ ধরনের কোনো তথ্য তাদের দেয়নি। মায়ানমারের কোনো নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কেউ প্রবেশ করলে তাদের আবার মায়ানমারে ফেরত পাঠানো হয় বলেও তিনি জানান।