DMCA.com Protection Status
title="৭

আওয়ামী লীগের ছল-চাতুরীঃ সংসদীয় কমিটির প্রধান হচ্ছেন সাবেক বিতর্কিত মন্ত্রীরাই

NationalParliamentofBangladesh_jpg1দৈনিক   প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ  বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া সাবেক নয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে কয়েকজন হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। কেউ আবার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্কিত।

বিশেষজ্ঞ ও সংসদ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ ধরনের সাবেক মন্ত্রীদের একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করার বিষয়টি সংসদের কার্যপ্রণািল বিধির পরিপন্থী। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে কমিটিতে কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে সভাপতি হিসেবে তারা তদন্তকাজ প্রভাবিত করতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্ট নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা উন্মোচিত হওয়ার পর সংসদ ও কমিটি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সামনে এ প্রশ্ন উঠে এসেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

এ ছাড়া দশম সংসদে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম, সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এবং সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনকে একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হককে করা হয়েছে একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।

সংসদবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে  বলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচিত হতে পারে বিধায় বাদ পড়া মন্ত্রীদের একই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা উচিত নয়। এতে সংশ্লিষ্ট কমিটি সরকারের কাছ থেকে জবাবদিহি আদায়ে ব্যর্থ হবে। কারণ, এসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কমবেশি অভিযোগ আছে।

সংসদের কার্যপ্রণািল বিধির ১৮৮ ধারায় বলা আছে, কোনো কমিটিতে সাংসদের আর্থিক, প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচিত হতে পারে, এমন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো সাংসদকে ওই কমিটির সদস্য করা যাবে না। গত সংসদে এ ধরনের ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে আবাসন ব্যবসায়ী সাংসদ নসরুল হামিদ ও এনামুল হককে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত কমিটি থেকে এবং পরিবহন খাতের ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সংসদ সচিবালয়-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, আইন না থাকায় এমনিতেই সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ ও সংসদের কার্যপ্রণািল বিধির ২৪৮ ধারায় বলা আছে, কমিটির কাজ হলো, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা, প্রশাসন সম্পর্কে অনুসন্ধান করা, মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং এ বিষয়ে সুপারিশ করা। সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদ আইনের দ্বারা কমিটিকে সাক্ষীদের হাজিরা তলব করা, শপথ, ঘোষণা বা অন্য কোনো উপায়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করা এবং দলিলপত্র দাখিলে বাধ্য করার ক্ষমতা দিতে পারবে।

কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন হওয়ার ৪২ বছর পরও এ আইনটি হয়নি। নবম সংসদে আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি আইন প্রস্তাব করলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তা অনুমোদন করেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত এই আইনটি না থাকায় সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সভাপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: এ বি তাজুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা ক্রেস্ট দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) সোনা ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা। বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় এসব ক্রেস্টে সোনা পাওয়া গেছে মাত্র সোয়া তিন আনা। রুপার বদলে পাওয়া গেছে পিতল, তামা ও দস্তা। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে তাতে কোনো সোনার অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি।



মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক সচিব মিজানুর রহমান ও বর্তমান সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকসহ ১৩ কর্মকর্তা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছে।



তার আগে গত ২৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি উপকমিটি গঠন করে। আফছারুল আমীন এই কমিটির আহ্বায়ক। কমিটি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, সভাপতি তদন্তকাজ প্রভাবিত করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যেতে পারেন।



তবে তাজুল ইসলাম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে  বলেন, ‘সভাপতি হিসেবে আমি কমিটির তদন্তকাজকে প্রভাবিত করব না। বরং দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করব এবং তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করব। কারণ, আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিএসটিআই প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের আমলারা তা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন।’

কমিটি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আগেও সংসদীয় কমিটির তদন্তকাজে সভাপতিদের প্রভাব খাটানোর নজির রয়েছে। গত সংসদে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরও সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল তা প্রকাশ করেননি এবং এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেননি। ওই প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে তিরস্কার করা হয়েছিল এবং সোনালী ব্যাংকের টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল।



সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, তাঁর স্ত্রী ইলা হকের নামে ব্যাংকে জমা ছিল সাত কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তঁার নামে জমা ছিল দুই কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রীর নামে ব্যাংকে জমা ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার টাকা এবং তাঁর নামে ছিল ৮৮ লাখ টাকা। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি নির্বাচন কমিশনে হলফনামা সংশোধনের আবেদন করে বলেছেন, ২০১৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীর নামে ব্যাংকে জমা ছিল ৪৫ লাখ টাকা। ভুলে তা সাত কোটি ৫৩ লাখ হয়ে গেছে।



মন্ত্রিত্বের শেষ পর্যায়ে ২০১২-১৩ সালে হাছান মাহমুদের বার্ষিক আয় দাড়ায় ১৮ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর আয় প্রায় দুই কোটি টাকা। ২০০৮ সালে তাঁদের বার্ষিক আয় ছিল ১৯ লাখ টাকার কিছু বেশি। সুজনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাঁদের সম্পদ বেড়েছে তিন হাজার ৮৯২ শতাংশ।

মন্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্যান্য কমিটির সভাপতিদেরও সম্পদ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। সংসদ সচিবালয়-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হওয়া এসব সভাপতির বিরুদ্ধেও যেকোনো সময়ে যেকোনো মহল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিটিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ  বলেন, এ ধরনের সমস্যা তো অতীতে কখনো হয়নি। এবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্রেস্ট কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে সমস্যাটি সামনে এসেছে। তাই এ বিষয়ে সংসদের আগামী অধিবেশনে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হবে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!