ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ রাজনীতি যখন গুম-খুনের মুখে জাতিকে অসহায় বানিয়ে রেখেছিল, বিচার বিভাগ সেখানে বাংলাদেশকে দিয়েছে শেষ ভরসা। এই ভরসায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল বিচারের আকাঙ্ক্ষা।
অভিযুক্তরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ চিৎকার করে প্রশ্ন তুলেছে, কেন আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও গ্রেফতার হচ্ছে না। শেষে যখন গ্রেফতার হলো, তাতেও রেখে দেওয়া হলো ফাঁক। খুনের মামলায় নয় গ্রেফতার দেখান হলো ৫৪ ধারায়। তখন আবারও আদালতকে ভরসা করে মানুষ চিৎকার করে উঠে। কেন সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকার পরও খুনের মামলায় গ্রেফতার নয়?
এইভাবেই আদালতের নির্দেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট তীব্র জনমতের কারণে শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয় অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা। গুম, খুন, নদীতে অজ্ঞাত মানুষের লাশ ভেসে আসা বর্তমান বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্র। আরও স্বাভাবিক হচ্ছে, মানুষ খুনের মত অপরাধ করে তা নিঃশব্দে হজম করে ফেলা। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পর পরিস্থিতি একই দিকে গড়াতে পারত। কিন্তু বাধ সাধে বিচার বিভাগ। আইনগত অধিকার প্রয়োগ করে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে বাধ্য করে হাইকোর্ট। আর, এতেই বিরক্ত হয়ে পড়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল।
গুম-খুন-অপহরণের সাথে নিজ দলের নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা পেলেও উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে বিচার বিভাগ তথা আদালতকেই চোখ রাঙাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
কোন ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির পক্ষে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করা ও রিটের প্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়ার অধিকার রাখে। এই অধিকার সাংবিধানিকভাগে স্বীকৃত। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর আদালত দ্রুত জরুরী উদ্যোগ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা নির্বাহী বিভাগকে বাধ্য করে। এরপরই ক্ষোভের ঝড় উঠে মন্ত্রীমহলে।
আদালতের আদেশে অভিযুক্ত তিন র্যাব সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এবং তখন থেকেই বিচার বিভাগের এখতিয়ারের প্রতি আঙ্গুল তুলেন সরকারের মন্ত্রী-মহোদয়গণ। এমনকি বিচার বিভাগকে শাসাচ্ছেনও তারা।
নারায়ণগঞ্জের সিটি প্যানেল মেয়র নজরুল ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী র্যাব সদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে। র্যাবের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠার পর রাতারাতি নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত র্যাবের সদর দফতর র্যাব-১১’র তিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সায়ীদ মোহাম্মদ ও মেজর আরিফ হোসেন এবং নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এস এম রানাকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর অভিযুক্ত তিন র্যাব সদস্যের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরো জোরদার হয়।
অভিযুক্ত র্যাবের কর্মকর্তা তারেক সায়ীদ দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। খুনের সাথে নিজ পরিবারের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করেন মায়া। এদিকে সাত খুনের সাথে স্বয়ং মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যসহ র্যাব সদস্যদের জড়িত থাকা ও দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে বরখাস্ত করে তাদের রাতারাতি সরিয়ে দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে নির্বাহী বিভাগ।
এদিকে সাত খুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের একজনের পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনের পক্ষে আদালতে লড়েন সিনিয়র আইনজীবী ড: কামাল হোসেন। সাতখুনের সাথে র্যাবের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ পেলে হাইকোর্ট অভিযুক্ত তিন র্যাব সদস্যকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেয়। এতে আদালতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয় মন্ত্রীমহল।
১৪ই মে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহীর কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জে সাতজনের হত্যার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার আশ্বাস দিলেও পরমুহূর্তই বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কাজে নাক না গলানোর পরামর্শ ও দেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “কিছু মানুষের অতি উৎসাহ এবং অতি তৎপরতা প্রকৃতপক্ষে আমাদের এই কার্যক্রমকে ব্যাহত করে দেয়। আর কথায় কথায় ঐ যে রিট করা এবং সেখান থেকে অর্ডার যাওয়া। যে কাজটা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বা যে কাজটা নির্বাহী বিভাগের, সেটা যদি বিচারবিভাগ করে দেয়, তারপর তো আর আমাদের করণীয় থাকে না। বিচারবিভাগ, নির্বাহী বিভাগ যার যার কাজ, সে করবে। একে অপরের পরিপূরক হয়ে তা করবে। কিন্তু এমন কিছু করবে না, যেটা একে অপরকে কাজ করতে বাধা দিয়ে ফেলে।”
অন্যদিকে, ২রা জুন রাজধানীর মহাখালীতে ‘মানবাধিকার সুরক্ষায় অভিজ্ঞতা বিনিময়’ অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগকে সীমানা অতিক্রম না করার প্রচ্ছ্ন্ন হুমকিও দেন আইনমন্ত্রী। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিচার বিভাগের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়, যাতে করে নৈরাজ্য তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘জনস্বার্থের মামলায় বিচার বিভাগ বিভিন্ন সময়ে যেসব উদ্যোগ নেয়, সেগুলোকে অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাদের সীমানা অতিক্রম করা উচিত নয়। এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে করে বিচারিক নৈরাজ্য (জুডিশিয়াল অ্যানার্কি) তৈরি হয়।’